উচ্চশিক্ষা ভ্রান্তি ও সম্রাট শাহজাহান

উচ্চশিক্ষা ভ্রান্তি ও সম্রাট শাহজাহান

সাফাত জামিল শুভ: শ্বাশত ভালবাসার অনন্য নিদর্শন- তাজমহল।পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য এই স্থাপত্যকে আবেগ্লাপ্লুত বাঙালীরা ভালবেসে নাম দিয়েছে ‘প্রেমের তাজমহল’। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের শাসনকালে এটি নির্মানের জন্য ব্যবহৃত হয় স্বচ্ছ মার্বেল পাথর, চীন থেকে সবুজ পাথর, তিব্বত থেকে স্বচ্ছ ও নীল পাথর এবং শ্রীলংকা থেকে নীলমনি। তাছাড়া ভারত, পাকিস্তান, পারস্য ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ২৮ রকমের মূল্যবান পাথর দিয়ে তৈরি করা হয় এই অনন্য স্থাপত্য। কথিত আছে তাজমহল তৈরির সব উপকরণ দূর-দূরান্ত থেকে নিয়ে আসার জন্য ১০০০ হাতিকে কাজে লাগানো হয়।

ঠিক কি পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়েছে তাজমহল নির্মাণে? ১৬৩২ থেকে ১৬৫৩ সাল পর্যন্ত নির্মাণ কাজে সম্রাট শাহজাহানের ব্যয় হয়েছিলো মতান্তরে প্রায় ৩২ মিলিয়ন রূপী। বর্তমান হিসেবে প্রায় ১০৬ কোটি ২৮ লাখ ৩৪ হাজার মার্কিন ডলার। তাত্ত্বিক হিসাব অনুযায়ী, এ পরিমান অর্থ বর্তমানের ৫২.৮ বিলিয়ন রুপি বা ৮২৭ মিলিয়ন ইউএস ডলারের সমান, অর্থাৎ ৬,৪৩৮ কোটি টাকার সমান। তবে এটা সম্ভবত আরো বেশি হবে।

তাজমহল নির্মাণের ১১ বছর পর শায়েস্তা খাঁ সুবেদার হয়ে বাংলায় আসেন। শায়েস্তা খাঁর আমলে টাকায় কত মণ চাল পাওয়া যেতো? ৮ মণ। অর্থাৎ তখন ১ মণ চালের দাম ছিল সাড়ে ১২ পয়সা বা .১২৫ টাকা। আর বর্তমানে ১ মণ চালের সর্বনিম্ন মূল্য কত? সম্ভবত: ৯০০ থেকে ১,০০০ টাকার মধ্যে হবে। ধরে নিলাম, ৯০০ টাকা। এখন ৯০০ কে .১২৫ দিয়ে ভাগ করলে ভাগফল হবে, ৭,২০০। এর মানে তখনকার চেয়ে এখন দাম বেড়েছে ৭,২০০ গুন বেশি। তাহলে তাজমহলের জন্য ব্যয়কৃত অর্থের পরিমান বর্তমানে দাঁড়াবে ৩২ মিলিয়ন x ৭,২০০ রুপি বা ২৩,০৪০ কোটি রুপিতে যা ২৮,৩১৪ কোটি টাকার সমান।

ভাবতে পারেন, এই টাকা দিয়ে এ উপমহাদেশে কতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মত উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র নির্মাণ করা যেতো? ইন্টারনেট ঘাটলে দেখা যায়, ইউরোপ আমেরিকায় হাজার বর্ষ অতিক্রম করা নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয় আছে, অথচ উপমাহদেশের মানুষের কি করুণ দূর্ভাগ্য, ‘শিক্ষা’ নামক মৌলিক বিষয়টি আমাদের তৎকালীন শাসকদের দৃষ্টি কাড়তে পারেনি। তাই নিজেদের প্রেমের স্মৃতিস্বরুপ স্থাপনা নির্মাণে মগ্ন ছিলেন।

অথচ সেসময় ইউরোপীয় দেশগুলোতে শিক্ষা ও সভ্যতার সুবাতাস বইছিল। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডে অবস্থিত ‘ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড’ সবচেয়ে প্রাচীন ও বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়। ধারণা করা হয় যে ১০৯৬ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব ক্যামব্রিজ প্রতিষ্ঠিত হয় মূলত ১২০৯ সালে। সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠানটি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অনুসরণীয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির অন্তর্গত ৩১টি কলেজ, ফ্যাকাল্টি এবং অনুষদগুলো শহরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। অবাক করার বিষয় যে মোট ৯০ জন নোবেল বিজয়ী এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন। 

এদিকে আমাদের দেশে প্রায়ই শোনা যায়, বিষয় সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের দুর্বলতা কিংবা সিলেবাস ও পঠন পাঠন পদ্ধতির কারণে গণিতে কিংবা ইংরেজির মত বেসিক বিষয়ে শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে থাকছে। আমাদের গণিত কারিকুলাম অনেকটা সেকেলে। এ কথা দিবালোকের মত সত্য যে, শিক্ষার্থীরা অনেক সময় গণিত মুখস্থ করে কিংবা পয়সা খরচ করে প্রাইভেট পড়ে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে গণিত শিক্ষকের ব্যাপক সঙ্কট রয়েছে। অন্য বিষয়ের শিক্ষক দিয়ে সেখানে গণিতের ক্লাস নেয়া হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক জরিপে দেখানো হয়েছে, ৪৫ শতাংশ গণিতের শিক্ষকেরই বিএসসি ডিগ্রিতে গণিত বিষয় ছিল না অন্যদিকে প্রাথমিক স্তরে বিষয় হিসেবে ইংরেজি চালু রয়েছে। এ স্তরে এক প্রকার জোর করেই শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শিক্ষা দেয়া হয়। আর ইংরেজি শিক্ষাদান পদ্ধতি পুরোপুরি অবৈজ্ঞানিক।

একটি প্রতিযোগিতার আগে সকল প্রতিযোগির জন্য সমান সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে স্কুল ছাত্র–ছাত্রীদের মধ্যে অসম প্রতিযোগিতা বিদ্যমান। স্কুলগুলোর ভৌত কাঠামো, সুযোগ–সুবিধা, শিক্ষকের মান, ছাত্র বেতন ইত্যাদি মৌলিক বিষয়গুলোতে প্রচন্ড বৈষম্য বিদ্যমান। যেমন, ক্যাডেট কলেজের একজন ছাত্রের জন্য সরকারের বার্ষিক ব্যয় প্রায় ৭৪ হাজার টাকা আর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন ছাত্র প্রতি বছরে ব্যয় হয় সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা।

বাংলাদেশ ও জার্মানির বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১৬০ জন করে শিক্ষার্থীর ওপর ২০০৯ সালের জুলাই থেকে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায়োগিক গবেষণা চালিয়ে দেখা যায় দক্ষতা নিরুপণে বিভিন্ন পরীক্ষায় বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা জার্মানির শিক্ষার্থীদের প্রাপ্ত নম্বরের এক–চতুর্থাংশ পেয়েছে। গবেষণায় মুখস্থ করে মনে রাখা, বোঝা, এবং প্রয়োগ এই তিনটি ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা যাচাই করা হয়েছে। মনে রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা ভালো করলেও পরবর্তী দুটি পর্যায়ে, অর্থাৎ বোঝা ও প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে ভালো করতে পারেনি। পাঁচ বছরের প্রশ্নপত্র বিশ্লেষণ করে ওই গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রশ্নপত্র প্রণয়নের ক্ষেত্রে ‘তাত্ত্বিক’ বিষয়ে প্রাধান্য দেওয়া হয়, এতে পরীক্ষার খাতায় ভালো নম্বর পাওয়া যায় বটে কিন্তু বাস্তব জীবনে কমই কাজে লাগানো যায়। অন্যদিকে জার্মানির ছাত্রদের যাচাইয়ের ক্ষেত্রে প্রায়োগিক দিকটাই প্রাধান্য পায়। তাই তারা সহজেই নিজেদের সৃজনশীলতাকে কাজে লাগাতে পারে।

আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো দেখে সাময়িক কষ্ট লাগলেও দিনশেষে এটিকেই স্বাভাবিক মনে করি। কেননা আমাদের জাতির একদম গোঁড়ায় সমস্যা। প্রকৃত শিক্ষার অভাবে এ উপমহাদেশের শিক্ষিত বোধসম্পন্ন নেতৃত্ব তথা প্রজন্ম গড়ে উঠতে বেশ দেরী হয়েছিল। যার প্রভাব কাটাতে পারিনি আমরা এখনো। সভ্যতা সেই অর্থে উপমহাদেশে এখনো এসেছে কিনা তা সন্দেহাতীত। তাই দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও নিজের সহপাঠীদের দ্বারা আবরার ফাহাদের মত মেধাবীর নির্মম মৃত্যু হয়। অসহায় হয়ে মরতে হয় ফেনী’র নুসরাত কিংবা কুমিল্লা’র তনু’কে। লাগামহীন দূর্নীতি কিংবা অবৈধ কালোবাজারিদের হাতে নিয়ন্ত্রিত হয় অর্থনীতি। আরও কত কি বাজে ঘটনা, যেগুলো সভ্য সমাজ ব্যবস্থার মানুষ কল্পনায়ও ভাবতে পারবেনা। প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ জনবিরোধী কোন কাজেই সম্পৃক্ত হতে পারেনা।

এদেশকে বিভিন্ন সময় অভাগা, দূর্ভাগা বলে অপবাদ দিয়েছেন অনেক লেখক, সাহিত্যিক কিংবা দার্শনিক। কৈশোরে নিজের দেশ সম্পর্কে নেতিবাচক এসব কথা শুনলে বেশ আহত হতাম। কালের বিবর্তনে বর্তমান পরিস্থিতি দেখে সত্যিই বিস্মিত হচ্ছি, দেশটা সত্যিই অভাগা। সাহিত্যিকরা “দূরদর্শী” ছিলেন বলেই হয়তো এমন মন্তব্য করতে পেরেছিলেন, আর এই দূরদর্শীতা নামক বস্তুর বড্ড অভাব ছিল মুঘল সম্রাট শাহজাহান কিংবা অন্যান্য উদাসীন শাসকদের।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.