স্কুলের গেট দিয়ে খুব দ্রুতই ঢুকছিলাম।দেরি হয়ে গেছে এমনিতেই।ফাইনাল পরীক্ষা চলছে।হাতে আর বিশ মিনিট মাত্র বাকী।মেয়ে ও তাড়া দিচ্ছিলো পুরো রাস্তা জুড়েই।
কী করে যে এতোটা দেরি হয়ে গেলো?
স্কুলের মেইন গেটে পৌঁছে ভীষণ একটা ধাক্কাধাক্কির মধ্যে পড়ে যেতে হলো।এটা নিয়মিতই হয়।এক ব্যাচ পরীক্ষা দিয়ে বের হয়,আর এক ব্যাচ ঢোকে।ফলে মোটামুটি একটা জটলা নিত্য নৈমিত্তিক,গা সওয়া হয়ে গেছে।
কিন্তু আজকে গেটের কাছে জটলাটা যেনো বেশিই মনে হলো।ভেতরে ঢুকতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিলো।একটু সামনে এগোনোর পর প্রকৃত বিষয়টা বোঝা গেলো।একটা ফ্রিজিং এ্যাম্বুল্যান্স দাঁড়িয়ে আছে সেখানে, আর তার আশপাশে ভীড় করে আছে মেয়েরা।কাছাকাছি গিয়ে জানলাম,এ্যাম্বুল্যান্সে করে পঞ্চম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীকে তার স্কুলে শেষবারের মতো আনা হয়েছে, তারই মায়ের ইচ্ছায়।
ভীষণই কষ্ট হলো।
জানলাম।ছোট্ট একটা মেয়ে, ফাইনালের তিনটা পরীক্ষা ও দিয়েছে।তারপরই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত এবং শারীরিক অবনতি, অতঃপর চলে যাওয়া।সহপাঠীরা অশ্রু সজল চোখে এক পলক দেখছিলো তাদের বন্ধুকে শেষ বারের মতো।কেউ কেউ শব্দ করে কাঁদছিলোও।অনেক গার্ডিয়ানই সন্তানতুল্য শিশুটার জন্য কেঁদে যাচ্ছিলেন দূরে দাঁড়িয়ে।
এ্যাম্বুল্যান্সটাকে এরপর স্কুলের ভেতরের বড়ো মাঠে নেওয়া হয় সমস্ত শিক্ষক,অভিভাবক এবং স্কুলের শিক্ষার্থীদেরকে দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য।প্রধান শিক্ষক,যিনি সর্বোচ্চ অভিভাবক,ক্রীড়া শিক্ষক-যার মধুর শাসন সর্বত্র চালু এবং অন্য শিক্ষকেরা,সাথে অভিভাবক ছাত্রীরা নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়েছিলো আশেপাশে।সারি বেঁধে মেয়েরা ক্রীড়া শিক্ষকের আদেশ মেনে এক নজর দেখে দেখে সামনের দিকে এগুচ্ছিলো।কোনোই বিশৃঙ্খলা নেই। এই একটা সময়ে আমরা কেনো জানি সবাইই খুব শৃঙ্খল হয়ে যাই-আমার বোধ হলো।
আসলেই!
কচি একটা মুখ কোথাও থেকে যেনো সবই দেখছিলো।তার প্রতি সবার ভালোবাসাকে অনুভব করছিলো হয়তোবা!
তাই কী?
মেয়েকে ভেতরে ঢুকিয়ে নিজেও যেয়ে দাঁড়িয়েছিলাম এ্যাম্বুল্যান্সের কাছে।একবার কাছে যেয়ে কাঁচের গ্লাসের এপাশ থেকে ওপাশে শিশুমুখটাকে দেখলামও।বুকের ভেতর কোথা থেকে যেনো একটা গভীর কান্না উঠে আসছিলো।আমি আগে দেখিনি, চিনিও না,কিন্তু এরা আমাদেরই সন্তান।
বারবার মনে হচ্ছিলো,এই মাঠে আর কখনোই আসা হবে না ছোট্ট এই মেয়েটার।গুটি গুটি পায়ে প্রথম শ্রেণিতে যে যাত্রা শুরু করেছিলো, পঞ্চমেই থেমে গেলো।স্কুলের মাঠ,ক্যান্টিন,করিডোর,প্লে-গ্রাউন্ড,দোলনা, স্লিপারে- আর ওঠা হবে না।কত আপন,কত প্রিয়—সব ছেড়ে অবেলায় বিদায়।আরো পাঁচটা বছর কিংবা কলেজ পর্যন্ত থাকলে আরো বেশি সময় থাকা হতো এই চত্তরে। কতো স্মৃতি জমা পড়তো,কতো উচ্ছাস- উন্মাদনা!
কিন্তু হায় নিয়তি!স্মৃতিগুলো সংক্ষিপ্তভাবেই জমা পড়ে থাকলো।
দোয়া পড়া হলো,’শান্তি হোক প্রিয় ছাত্রীর’ কামনাও করলেন শিক্ষকসহ সবাই…… এবং এরপর ছেড়ে যাওয়া। বিদ্যালয়ের আর আসা হবে না।এবার অন্য যাত্রায়…..অনন্ত যে যাত্রা।
ভালো থেকো তুমি ছোট্ট মেয়ে ওপারে।
মায়ের মন খুঁজে বেড়াবে নিশ্চয়ই প্রিয় কন্যাকে, বিদ্যালয়ের আশেপাশে এলেই কখনোবা। স্বল্প সময়ের স্মৃতি কাতরতায় আচ্ছন্ন ও হবে। কিন্তু তারপর বাস্তবতায় আবারো ফিরে যেতে বাধ্য হবে,জীবনের নিয়মেই।
রেহানা আক্তার লুনা
০১.১২.২২