এই মন্দিরটি সারা বিশ্বের মানুষের কাছে ‘স্নেক টেম্পল’ নামে পরিচিত। সাপের ছড়াছড়ি এখানে। তাই এটিকে সাপের মন্দির হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
কিভাবে যেতে হবে সেখানে
বিমান থেকে মালয়েশিয়ার পেনাং দ্বীপে নামলেই যেখানে পা পড়বে আপনার, সেটির নাম বায়ান লেপাস বিমানবন্দর। বিমানবন্দরটি পেরিয়ে একটু সামনে এগোলেই সানগাই ক্লুয়াং অঞ্চল। এখানে আছে একটি বাস স্টপেজ। টিকিট কেটে বাসে চড়ে বসলেই পৌঁছে যাবেন গন্তব্যে। এশিয়া তো বটেই, বিশ্বের নানা দেশ থেকেই অসংখ্য দর্শনার্থী এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পুণ্যার্থীরা মনোবাসনা পূরণ করার জন্য আবার অনেকেই স্রেফ ঘুরে দেখতেই আসছেন সাপের মন্দিরে। তাইতো এটি পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে উঠেছে। মজার ব্যাপার হল, মন্দির সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষ বাসস্ট্যান্ড থেকে মন্দির পর্যন্ত পুরো পথেই শিল্পীর তুলিতে আঁকিয়েছেন নানা অলৌকিক ঘটনার দেয়ালচিত্র।
কি আছে মন্দিরে
আজব এসব ঘটনা দেখে অবাক হওয়ারও উপায় নেই। কারণ মন্দিরের ভেতরে পরিবেশটা এতটাই আলাদা যে, চমকে যাবেন খুব সাহসী মানুষও। মন্দিরের ঠিক সামনেই বসানো আছে ধূপ পোড়ানোর বড় একটি পাত্র। প্রতিদিন ধূপের ধোঁয়া মেখে সর্প দেবতার কাছে মনোবাসনা জানাচ্ছেন অসংখ্য পুণ্যার্থী। তবে সন্দেহবাদীরা বলছেন, ধূপের ধোঁয়ার উৎকট গন্ধেই বেশির ভাগ সময় নিথর হয়ে পড়ে থাকে বিষাক্ত সাপগুলো। মা মনোষার কথা সবারই জানা। হিন্দু ধর্মাবলম্বিরা মা মোনষাকে পূজা করেন। এই মন্দিরের আরেকটু সামনে এগোলেই দেখা যাবে বড় একটি পাত্রে রাখা আছে নানা জাতের পাখি আর মুরগির ডিম। ওগুলো সাপের খাবার। যদিও ডিমের চেয়ে বাদামই খেতে বেশি পছন্দ করে মন্দিরের কর্তারা।
কি কি সাপ আছে এখানে
এই সর্প মন্দির প্রাঙ্গণ তো বটেই এমনকি ভেতরের নানা গাছের ডালেও মনোহর ভঙ্গিতে আয়েশ করে ঝুলছে নানা রঙের সাপ। আকারে, প্রকারে তারা বিচিত্র। অজগরের মতো প্রকাণ্ড সাপের পাশাপাশি আছে হাতের আঙুলের চেয়েও চিকন সাপ। গায়ের রং এতই বর্ণিল যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়।
কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই মন্দির
এত সাপের এই মন্দিরটি কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেও এক দারুণ গল্প। চীনা ও ভারতীয় অভিবাসীরাই পেনাং রাজ্যের সংখ্যাগুরু অধিবাসী। তাদের অনেকেই বিশ্বাস করেন, কয়েক শতক আগেও পেনাং ছিল জঙ্গলময়। নবম শতাব্দীতে জঙ্গলে বসবাস করতেন এক বৌদ্ধ ভিক্ষু। চর সু কং নামের এ ভিক্ষুই ভয়ংকর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় রক্ষা করেছিলেন সাপগুলো। দিয়েছিলেন আশ্রয়, বেঁচে থাকার জন্য সেগুলোকে যুগিয়েছিলেন খাবারদাবার। আর দশজনের মতো ভয়ংকর সরীসৃপদের মোটেও ঘৃণা করতেন না তিনি। বরং ভালবাসতেন প্রবলভাবে। তার নামেই আজব এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৫০ সালে। প্রতিষ্ঠাতার মূর্তি বসানো আছে মন্দিরের মাঝখানের মূল প্রার্থনা কক্ষে। মজার ব্যাপার হল- সর্পমন্দিরের আসল নাম কিন্তু ‘টেম্পল অব দি আজিউর ক্লাউড’।
পেনাংয়ে অপরূপ সুন্দর নীল আকাশের সঙ্গে তুলনা করে রাখা হয়েছে নামটি। মন্দিরের ভেতরের ঠিক ডান পাশে রাখা আছে দক্ষিণা বাক্স এবং দর্শনার্থীদের স্বাক্ষর দেওয়ার জন্য একটি খাতা। খাতায় তারা লিখতে পারেন নিজের অভিজ্ঞতা বা কোন মন্তব্য। খুশি হয়ে বাক্সে অনেকেই অর্থ দান করেন। সাপগুলোর খাবার এবং রক্ষণাবেক্ষণ খরচ চালানো হয় এ টাকায়।
আর কি আছে মন্দিরের পাশে
এই মন্দিরটির ঠিক পেছনেই বড় একটি গর্ত। তবে পানিতে পূর্ণ নয়, গর্তে রয়েছে নানা জাতের ফলের গাছ। ফলের গাছে ভরা গর্তের পাশে দাঁড়ালে প্রথমেই চোখে পড়বে নানা রং আর জাতের ফল থোকায় থোকায় ঝুলে আছে গাছগুলোতে। তবে আরেকটু মনোযোগ দিয়ে ডালপালাগুলোর আড়ালে ভালোভাবে চোখ রাখলেই দেখা যাবে- জটলা পাকিয়ে পেঁচিয়ে রয়েছে বিষধর সব সাপ!
এই সাপগুলো কি বিষধর
এই ‘সাপগুলো যথেষ্ট বিষধর। তবে ওরা কাওকে কামড়ায় না। অন্তত এ পর্যন্ত কাওকে কামড়াতে দেখিনি কেও। অসম সাহসী কোন দর্শনার্থী তো মাঝেমধ্যেই গায়ে জড়িয়ে নেন কোনো কোনো সাপ। তখনও দুর্ঘটনা ঘটে না’- এভাবেই সাপগুলো সম্পর্কে মতামত জানালেন মন্দিরের এক কর্মকর্তা।
কারও কারও মতে, বিষদাঁত ভেঙে ফেলা হয়েছে সাপগুলোর। তবে পুরনো এক স্বেচ্ছাসেবক এ ঘটনা পুরোপুরিই অস্বীকার করলেন, ‘কানো সাপেরই বিষদাঁত ভাঙা হয়নি। ‘কারণ আমাদের কাছে এগুলো খুবই পবিত্র। আমাদের এগুলোর দাঁতে হাত দেওয়ার অনুমতি নেই।’ তবে স্বীকার করলেন, সাপগুলো আসলেই খুব বিষধর। তিনিও মনে করতে পারলেন না মন্দিরের সাপ আসলেই কোনদিন কাওকে কামড়েছে কিনা। সাপগুলো দেখাশোনা করার জন্য আছেন স্বেচ্ছাসেবক। প্রতিদিন সকাল ৫টায় মন্দিরটি খুলে দেন তারা। খোলা রাখেন সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত। তবে দর্শনার্থীরা মন্দিরে প্রবেশ করতে পারেন সকাল ৯টার পর। মন্দির থেকে তাদের বেরিয়ে যেতে হয় সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে। কোন প্রবেশ ফি দেওয়া লাগে না। এই মন্দিরের পেছনেই রয়েছে ছোট্ট একটি ‘সর্প জাদুঘর’।
সেখানে বৈজ্ঞানিক উপায়ে সংরক্ষণ করে রাখা আছে মরে যাওয়া সাপ। যেভাবে মমি করে রাখা হয় ঠিক সেভাবে সাপগুলোকে রাখা হয়েছে এই যাদুঘরে।
দর্শনার্থী আসেন প্রতিদিন
প্রতিদিন এ মন্দির দেখতে আসছেন প্রায় শত শত দর্শনার্থী। কেও কেও আসছেন আমেরিকা, ইউরোপ এবং চীন থেকেও। প্রতিবেশগত কারণে দিন দিন মন্দিরের সাপের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বংশবৃদ্ধিও হচ্ছে না আগের মতো। এ সমস্যা চিন্তিত করে তুলছে সবাইকে। মন্দিরের শুভানুধ্যায়ীরা অবশ্য একটি বিকল্প উপায় অবলম্বন করতে শুরু করেছেন। চুর সুং কং উৎসবে তারা মন্দিরে সাপ উপহার দেওয়া শুরু করেছেন। প্রতিবছর তিনবার আয়োজন করা হয় উৎসবটির। জানা যায়, চৈনিক ক্যালেন্ডার অনুসারে প্রথম মাসের ষষ্ঠ দিনে আয়োজন করা হয় প্রথম অনুষ্ঠান। বাকি দুটো উৎসবের আয়োজন করা হয় পাঁচ মাস পর পর। এসব উৎসবে বুদ্ধিষ্টরা আসেন। আবার দর্শনার্থীরাও আসেন এ সময়। কারণ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ অনেকেই সৌভাগ্যের নিদর্শন বলেই মনে করে থাকেন। তবে যাই হোক, অনেক দর্শনার্থীরা আসেন এই সর্প মন্দিরটি দেখতে। আপনার যদি সাহস থাকে আপনিও যেতে পারেন এই সর্প মন্দিরে। আবার ইচ্ছে করলে গলায় সাপ জড়িয়ে ‘সাহসি উপাধি’ও অর্জন করতে পারেন। সৌজন্যে: দৈনিক যুগান্তর অনলাইন।