আয়ুষ্মান হবার চাবির খোঁজে

আয়ুষ্মান হবার চাবির খোঁজে

Wc copyবুলা ঝা ভট্টাচার্য: তা হলে কি আমি-আপনিও চাইলে, হয়ে যেতে পারি ‘যযাতি’? চাইলে কি আমরা আমাদের আয়ু বাড়িয়ে নিতে পারি? দেহের ‘আজব ঘড়ি’টিকে চালাতে পারি আমাদের ইচ্ছেমতো?

‘‘মরিতে চাহি না আমি এ সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই,
এই সৌরকরে এই পুষ্পিত কাননে, জীবন্ত হৃদয় মাঝে যেন স্থান পাই।’’

এই প্রার্থনা তো আমাদের সকলেরই। সমুদ্র মন্থন করে অমৃতকুম্ভের সন্ধান যে শুধু দেবতারাই করেছেন, তা নয়। যুগ যুগ ধরে মানুষেরও কামনা সেই ‘অমৃত’টুকু পান করার।

তা হলে কি আমি-আপনিও চাইলে১

সেই আয়ুষ্মান জিনের সন্ধানে।

আয়ুষ্মান জিনের সন্ধানে

সে ক্ষেত্রে প্রথমেই আমাদের মনে যে প্রশ্নটি আসে, তা হল- আমাদের বার্ধক্য আসে কেন? আমাদের শরীরে কী এমন ঘটে, যার ফলে আমরা বুড়ো হই?

সেই ‘অমৃতকুম্ভে’র সন্ধানে নেমে একেবারে হালে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, কী ভাবে আমাদের দেহে বার্ধক্য আসে, তা বুঝতে গেলে প্রথমেই জানা দরকার- কেন, কোন কোন কারণে শরীরের এক-একটি কোষ শিকার হয় বার্ধক্যের। আর তার জন্য আমাদের কোষগুলোর কী ভূমিকা রয়েছে? বা, আমাদের লাইফস্টাইল কতটা দায়ী?

একটি আজব ঘড়ি

লক্ষ-কোটি কোষ দিয়ে আমাদের শরীর গড়ে ওঠে। যত দিন সেই কোষগুলো এক সঙ্গে কাজ করে, আমরা হেসেখেলে বেঁচে থাকি। আর যখন তাদের এক সঙ্গে কাজের ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটে, তখনই আমরা শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। শরীরে জড়তা আসে। একটু একটু করে পৌঁছে যাই বার্ধ্যকের দোরগোড়ায়। তাই বার্ধক্য পৃথিবীর সব প্রাণীরই অনিবার্য ভবিষ্যৎ।

প্রাণীজগতে যেমন রয়েছে অতি স্বল্পায়ু প্রাণী। তেমনই রয়েছে অতি দীর্ঘায়ু প্রাণীও। যেমন, কিছু কিছু প্রাণী আছে, যারা এক বার প্রজননের পরেই মারা যায়। আবার গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের কিছু কচ্ছপের বয়স ১৭০ বছর। সামুদ্রিক লবস্টারের বয়স ১৪০ বছর। আর বিশেষ কয়েকটি সামুদ্রিক ঝিনুকের বয়স ৪০০ বছরের ওপর।

ভাবুন, সেই চন্দ্রগুপ্তের আমল থেকে তারা দিব্যি বেঁচেবর্তে রয়েছে!

জিন

সেই আয়ুষ্মান জিনের সন্ধানে।

বিজ্ঞানীরা দেখেছেন প্রত্যেকটি প্রাণীর ক্ষেত্রে তাদের শরীরের কোষগুলো কত দিন বাঁচবে, তা পুরোপুরি নির্ভর করে কোষের মধ্যে থাকা একটা আশ্চর্য ‘জৈবিক ঘড়ি’ বা ‘বায়োলজিক্যাল ক্লক’-এর ওপর। এই ঘড়িটির মেয়াদ শুধুই কিছুটা সময়ের জন্য। আর ওই ঘড়ির চলা শেষ হলেই কোষগুলোর মৃত্যু হয়।

দেখা গিয়েছে, বেঁচে থাকার সময় শরীরের কোষগুলো ক্রমাগত নিজেদের ভাঙে। যাকে বলে ‘বিভাজন’। এই ভাবে নিজেদের ‘DNA কপি’ বা প্রতিচ্ছবি বানিয়ে তারা নতুন নতুন কোষ তৈরি করে। ১৯৩০ সালে লেওনার্ড হেফ্লিক মানুষের কোষগুলোর ওপর গবেষণা চালাতে গিয়ে দেখলেন, মানুষের কোষগুলো অন্তত ৫০ বার নিজেদের ভাঙতে বা ‘বিভাজন’ করতে পারে। যাকে ‘হেফ্লিক লিমিট’ বলা হয়। আর এই প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ করতে তাদের ঠিক ৯ মাস সময় লাগে। এই কোষ বিভাজন প্রক্রিয়াটি এক-একটি পশুর ক্ষেত্রে এক-এক রকম। যেমন, গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের কচ্ছপের ক্ষেত্রে এই ‘হেফ্লিক লিমিট’টি ১২৫ বার হয়। আর কোনও মানুষ ৮৫ বছর বেঁচে থাকলে, তার ‘হেফ্লিক লিমিট’টি হয় সাকুল্যে ২০ বার। এই ভাবেই ‘হেফ্লিক লিমিট’-এর সঙ্গে সেই প্রাণীর সম্ভাব্য আয়ুর একটা যোগসূত্র থাকে।

আজব ঘড়ি, ক্রোমোজোম ও কোষ বিভাজন

কোষের মধ্যেই থাকে ডিএনএ। আর ক্রোমোজোম যেন একটা বাক্স! সরু সুতোর মতো ডিএনএ-গুলো সেই ক্রোমোজোমের ‘বাক্সে’ রাখা থাকে। আমাদের বংশপরম্পরার (জেনারেশন্‌স) সব খবরাখবরই তারা বয়ে নিয়ে চলে ঠাকুর্দা থেকে বাবায়। বাবা থেকে ছেলেয়। ছেলে থেকে তাঁর ছেলেয়। আর তার জন্য ক্রমাগত বিভাজন হয় কোষের। আর সেই কোষ বিভাজনের সময় ডিএনএ-গুলো ক্রমাগত নিজেদের ‘কপি’ বানাতে থাকে, একের পর এক। আর সেটা করতে গিয়ে ভুলও করে ফেলে! কী ভাবে ভুলটা করে তারা? কোথায় ভুলটা করে? ভুলটা করে তার ল্যাজের দিকটা ‘কপি’ করতে গিয়ে। আর সেই ভুলটা এক বার নয়। তারা সেই ভুলটা করে বার বার।

ওই ভুলটা যাতে বার বার না হয়, সে জন্য প্রকৃতিই ক্রোমোজমের ল্যাজে ‘টেলোমেয়ার’ নামে এক রকমের নিষ্ক্রিয় ডিএনএ-র ‘টুপি’ পরিয়ে দিয়েছে। যাতে বংশপরম্পরায় বয়ে বেড়ানো সব খবরাখবরই তারা ধরে রাখতে পারে। তাই প্রত্যেক বার ‘কপি’ করতে গিয়ে ডিএনএ খাটো না হয়ে ক্রমশই ছোট হতে থাকে ‘টেলোমেয়ার’। আর এই ভাবেই এক সময়ে সেটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। আর কোষগুলো ‘কপি’ করতে না পেরে মরে যায়।

এই ভাবেই আমাদের আয়ু আমাদের ক্রোমোজমের ‘টেলোমেয়ার’ কতটা লম্বা, তার ওপর নির্ভর করে। যা কি না আমরা অর্জন করি আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে।

তা হলে কেন ‘টেলোমেয়ার’ সরিয়ে দিলে কোষ বিভাজন চালিয়ে যাওয়া যাবে না?
দেখা গিয়েছে, ‘টেলোমেয়ার’ সরিরে নিলে সাধারণ কোষগুলো ক্যান্সার কোষগুলোর মতো বেপরোয়া হয়ে যায়! তখন তারা নিজেদের ‘টেলোমেয়ার’ নিজেরাই তৈরি করে। আর অসংখ্য বার তার বিভাজনও হয়। যা কি না ‘টিউমার’ তৈরি করতে পারে। এই ভাবে চলতে চলতে শেষমেশ কোষের ‘আজব ঘড়ি’টি আর কাজ করে না!

আয়ুষ্মান হবার জিন!

সেই আয়ুষ্মান জিন ‘ডিএএফ-১৬’। অণুবীক্ষণের তলায়।
কোন জিন আমাদের আয়ু বাড়ায়? কোন কোন জিন?
গত কয়েক দশক ধরে বিজ্ঞানীরা কোষগুলোর ভেতরকার সেই জিন-কে চেনার কাজে লেগে আছেন। যাতে কি না মানুষের আয়ু উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়ে যেতে পারে। ১৯৯৩ সালে বিজ্ঞানী সিন্থিয়া কেনিয়ন একটি কেঁচো জাতীয় প্রাণীর (নেমাটোড) মধ্যে ‘ডিএএফ-টু’ আর ‘ডিএপি-সিক্সটিন’ বলে দু’টি জিন আবিষ্কার করলেন। যে দু’টি জিন ওই প্রাণীটির কোষের ‘আজব ঘড়ি’টির সঙ্গে যুক্ত। এর ফলে, প্রাণীটির আয়ু (যা কি না শুধুই ১৪ দিনের) বাড়িয়ে দ্বিগুণ (২৮ দিন) করে দিতে পেরেছিলেন।
কী ভাবে জানেন?

image

সেই আয়ুষ্মান জিন ‘ডিএএফ-১৬’। অণুবীক্ষণের তলায়।

‘ডিএএফ-টু’ জিনের রূপান্তর ঘটিয়ে, নতুন ‘ডিএপি-সিক্সটিন’ জিন বানিয়ে। যার জন্য নেমাটোডের আয়ুই শুধু লক্ষ্যণীয় ভাবে বেড়ে গেল, তা-ই নয়। জীবাণুর হানাদারি থেকে তাদের বাঁচার ক্ষমতাও বাড়িয়ে দিল। বাড়িয়ে দিল ‘অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট’ বানিয়ে কোষের মধ্যে থাকা বিষ নষ্ট করে দেওয়ার ক্ষমতাও।
সঙ্গে সঙ্গে এটাও লক্ষ্য করা গেল, ওই নেমাটোডের আয়ু বেশ খানিকটা বেড়ে গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তারা পরিবেশগত পরিস্থিতির জন্য অসুস্থ হয়ে মরে যাচ্ছে। তাই আয়ুষ্মান হওয়ার জন্য শুধু জিনেরই নয়, পরিবেশেরও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে বোঝা গেল।

মানুষের ক্ষেত্রে এমন কি কোনও জিন রয়েছে, যা আমাদের আয়ুষ্মান করতে পারে?

আয়ু বাড়ানোর জিন। অণুবীক্ষণের তলায়।

আয়ু বাড়ানোর জিন। অণুবীক্ষণের তলায়।

আয়ু বাড়ানোর জিন। অণুবীক্ষণের তলায়।

উত্তরটা হল, বিজ্ঞানীরা এমন একটি জিনের সন্ধান পেয়েছেন, যেটি নেমাটোডটার মতোই ‘ডেথ অ্যাসোসিয়েটেড প্রোটিন’ বা ‘ডিএপি জিন’। ল্যাবরেটরির পরীক্ষায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, এটি কোষের মধ্যে একটি ‘গ্রোথ হরমোন’- ‘আইজিএফআই’-এর পরিমাণ কোষের মধ্যে অনেকটাই বাড়িয়ে দেয়। তার ফলে, কোষগুলো নিজেদেরকে অসুস্থ হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পারে, প্রচুর পরিমাণে ‘অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট’ বানায়। আর এই ভাবে পুরনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে নতুন জীবন দেয়। যদিও এই আবিষ্কারটি এখনও পর্যন্ত শুধু ল্যাবরেটরিতেই সীমাবদ্ধ, কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে মানুষের ওপর এর প্রয়োগের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

আয়ু ও ক্যালরির ভূমিকা

বিজ্ঞানীরা লক্ষ্য করেছেন, খুব অল্প ক্যালরির খাবারের সঙ্গে আয়ুষ্মান হওয়ার একটা যোগসূত্র রয়েছে। অতি সম্প্রতি তাঁরা দেখেছেন, যাঁরা কম ক্যালরির খাবার খান, তাঁদের কোষে ‘আইজিএফ-ওয়ান’ তৈরি হয় বেশি বেশি করে। এই ‘আইজিএফ-ওয়ান’ই শরীরের বাড়- বৃদ্ধির সহায়ক |

আয়ু বাড়ানোর জিন: দেখুন ভিডিও।

বংশপরম্পরা

এ তো গেল বিজ্ঞান এর কথা। সব শেষে বলি, আপনি ক’দিন বাঁচতে পারেন, তা জানতে চাইলে আপনার পূর্বপুরুষরা কে কত দিন জীবিত থেকেছিলেন, তার একটা হিসেব রাখুন। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, আপনার আয়ুর ২০-৩০% আপনার পরিবারের গড় আয়ুর ওপরেই নির্ভর করে। আর তার সঙ্গে ব্যায়াম করা ও কম ক্যালরির খাবার খাওয়া উচিত। কমানো উচিত মানসিক চাপ, ধুমপান ও মদ্যপান। এগুলোই আমাদের আয়ু বাড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে।

বার্ধক্য থেকে তারুণ্য

যুগ যুগ ধরে মানুষ রয়েছে সেই ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’! যাতে চিরকালের জন্য সে তরতাজা, তরুণ হয়ে থাকে। এখন প্রশ্নটা হল, ভবিষ্যতে কি আমাদের শরীরের কোষগুলোকে আমরা যত দিন চাই, তত দিন ধরে তরুণ, তরতাজা করে রাখতে পারব?
উত্তরটা হল, পারবই! যদি আমরা আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে একেবারে সুস্থ করে তুলতে পারি! সেগুলোর ভেতরকার কয়েকটি বাছাই করা কোষকে যদি ‘জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর মাধ্যমে পারি পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে!
আর এটা কোনও কল্পকাহিনী নয়। নয় কোনও ‘ফ্যান্টাসি’!

সে দিনের আর খুব একটা দেরি নেই!

(লেখক: বিশিষ্ট নিউরো-সায়েন্টিস্ট। ইলিনয়ের শিকাগোয় নর্থ-ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অফ নিউরোলজির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর।)

-ছবি ও ভিডিও সৌজন্যে: নর্থ ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, শিকাগো।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.