মোনায়েম সরকার: যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর সফর নিয়ে সরকারবিরোধী মহল এমন একটি ‘আশাবাদের’ মধ্যে ছিল এবং তা বিভিন্নভাবে প্রচারও করেছিল যে, তিনি বাংলাদেশ সরকারের ওপর আরও বেশি চাপ সৃষ্টির জন্যই এখানে আসছেন। বাস্তবে তেমন কিছু ঘটেনি, বরং ঘটেছে বিপরীতটি। লু সাহেব একজন দক্ষ কূটনীতিক। তিনি প্রায় ৩৩ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরে কাজ করছেন এবং দীর্ঘদিন নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছেন আমাদের এ অঞ্চলটি। এখানে কোথায় কী ঘটছে, সে বিষয়ে তারা নিজস্ব চ্যানেলেও ভালোভাবে খবর রাখে এবং নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করেই কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে থাকে। এ অবস্থায় মিস্টার লুর ব্যক্তিগতভাবে কোথাও কিছু করার নেই। তিনি তার দেশের পররাষ্ট্র দপ্তরের পক্ষে সুনির্দিষ্ট দায়িত্বই পালন করে চলেছেন। সেজন্য পাকিস্তানে ইমরান সরকার পতনের পর খোদ ইমরান খান তার নাম ধরে কী বলেছিলেন, তা লু সাহেবের বাংলাদেশ সফরের আগে এখানে প্রচার করার কোনো যৌক্তিকতা ছিল না। তবে অতিউৎসাহে কোনো কোনো মিডিয়াও এমন কাজ করেছিল, যেন বাংলাদেশে তিনি এমনতরো ঘটনা এগিয়ে নিতেই আসছেন। বাস্তবে ডোনাল্ড লু নিজেই বললেন, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক জোরদার করতেই তিনি এসেছেন। তার সফরের আগে যুক্তরাষ্ট্রের আরেক নিরাপত্তা বিষয়ক কর্মকর্তা বাংলাদেশ সফর করে যান। সেই সফরের শেষেও বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তার ইতিবাচক আলাপ ও সম্পর্কের অধিকতর অগ্রগতির কথাই জানা যায়। মিস্টার লুর দুদিনের সফর শেষে আরও বেশি ইতিবাচক সংবাদ পাওয়া গেছে দু’পক্ষ থেকে।
এখানে একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমানের বক্তব্য উদ্ধৃত করতে চাই। তিনি বলেছেন, ‘ডোনাল্ড লু কোনো গোপন সফর করেননি। তার বক্তব্য রেকর্ডেড। এ কারণে তার বক্তব্যের অপব্যাখ্যা করার সুযোগ নেই।’ কথাটি তুলতে হলো এজন্য যে, মিস্টার লু তার সফর শেষ করে চলে যাওয়ার পর থেকেই র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞাসহ কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক মহলে পাল্টপাল্টি বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে এবং তাতে জনমনে কিছুটা বিভ্রান্তিও ছড়িয়েছে। এক্ষেত্রে বিভ্রান্তির সুযোগ আসলে নেই। কারণ উন্মুক্ত সংবাদ সম্মেলনে মিস্টার লু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম এ মোমেনকে সামনে রেখেই সংবাদকর্মীদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এসেছে, এটা কোনো গোপন খবর নয়। বাংলাদেশ সেই অপ্রত্যাশিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজও করছে। তাতে পুরোপুরি সাফল্য এখন পর্যন্ত না এলেও নতুন করে যে কোনো নিষেধাজ্ঞা আসেনি, সেটাও কম নয়। আর এটা মিস্টার লু নিজেই বলেছেন এবং এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি র্যাবের নিষেধাজ্ঞা পরবর্তী কর্মকা-ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এখানে সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলেও ডোনাল্ড লুর বক্তব্যে মনে হয়েছে। মতপ্রকাশের অধিকার, রাজনীতি করা ও সভা-সমাবেশের অধিকার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন বরাবর যা বলে থাকে, সে কথাই তিনি নতুন করে বলেছেন। গত ১০ ডিসেম্বর রাজধানীতে বিএনপির ডাকা সমাবেশ ঘিরে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিলÑ তাতে সরকার যেভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে, সেটা নিয়েও সন্তোষ প্রকাশ করেছেন তিনি। সর্বশেষ ক্রসফায়ারের ঘটনা তদন্তে সরকার যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, সে বিষয়েও যে তিনি অবহিতÑ সেটাও বোঝা গেছে যুক্তরাষ্ট্রের এ কর্মকর্তার বক্তব্যে। বোঝা যায়, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নে সরকার যা কিছু করছে, সেদিকে তাদের দৃষ্টি রয়েছে এবং বিরোধী দল যে স্বাভাবিক রাজনৈতিক কর্মকা- চালাতে পারছে, সে বিষয়েও তারা সন্দেহমুক্ত। একটি ইংরেজি দৈনিকে ডোনাল্ড লু যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, সেটি পড়লেও বুঝতে কষ্ট হয় নাÑ বাংলাদেশ ও এর সরকারের কর্মকা-ে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন খুব নেতিবাচক অবস্থানে নেই। বরং বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের বার্তাই যেন দিচ্ছে মিস্টার লুর বক্তব্য।
এসব কথা বলতে হলো এজন্য যে, বিশেষত র্যাবের ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞা ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে মাঝে কিছুটা তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছিল এবং সরকারের মধ্যে এমন খবরও বিভিন্ন মহল থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, আরও নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ইউরোপীয় দেশগুলো থেকেও নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে বলে কিছুটা শংকা তৈরি হয়েছিল। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এসব দেশ প্রভাবশালী শুধু নয়, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের দেশগুলোয় আমাদের অনেক নাগরিক বসবাস করেন। তারা এখানে অর্থকড়িও পাঠান। এসব দেশ আমাদের উন্নয়ন সহযোগী বটে এবং আন্তর্জাতিক যেসব সংস্থা অর্থনৈতিক কর্মকা-ে সহায়তা জুগিয়ে থাকে, তাদের ওপর রয়েছে এসব দেশের প্রভাব। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রসহ ওইসব দেশেই আমরা প্রধানত রফতানি করে থাকি। আমরা যে তৈরি পোশাকের বাজারে বিশ্বে মর্যাদার আসনে আছি, সেটা মূলত এসব দেশে পণ্য রফতানি করে। যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের নিরাপত্তা সম্পর্কও কম নয় এবং সেটা আরও জোরদার করার কথা বলা হয়ে থাকে। এসব দেশ থেকে বিনিয়োগও আমরা আরও বাড়াতে চাই। নির্বাচন ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা, প্রযুক্তি সহায়তা, কৃষি, পরিবেশ উন্নয়নের মতো বিষয়েও পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের দীর্ঘ সহায়তামূলক সম্পর্ক রয়েছে। কোনো কারণে এ বহুমুখি সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হোক, তা কখনোই কাম্য নয়। তবে এটা বলতে হয়, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে বিশেষ তৎপরতা চালানো হয়ে থাকে। বিপুল অর্থ ব্যয় করে লবিস্ট নিয়োগের মধ্যেমে তাদের ভুল বুঝানোর চেষ্টাও আমাদের নজর এড়ায় না। দুদেশের সম্পর্ক অচিরেই খাদের কিনারে চলে যাবে বলে দেশের বাইরে থেকেও প্রচারণা কম চালানো হচ্ছে না। সত্যি বলতে এর বশবর্তী হয়েই কোনো কোনো মহল এবং কিছু মানুষের মধ্যে এমন ‘আশাবাদ’ ছড়িয়েছিল যে, ডোনাল্ড লুর সফরে বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবেই আরও চাপে পড়বে এবং তাতে সরকারবিরোধীদের বিশেষ সুবিধা হবে। সে আশার গুড়ে বালি পড়েছে। বর্তমান সরকারের জন্য বিশেষ বিব্রতকর হতে পারে, এমন কোনো কিছুই তার সফর থেকে বেরিয়ে আসেনি। বরং দু’পক্ষের সম্পর্ক যে আরও উন্নত ও মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে, সে বার্তা মিলল এখান থেকে। বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বাইডেন প্রশাসনের বিশেষ আগ্রহ রয়েছে, এটা আমরা সহজেই বুঝতে পারি। এটি যাতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয় এবং অংশগ্রহণমূলক হতে পারে, সেটা বাংলাদেশ সরকারও চায়। লু সাহেব বলে গেছেন, এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা তিনি জানেন এবং এর বাস্তবায়ন দেখতে তারা আগ্রহী। সেই নির্বাচন এখনও অনেক দূরে আছে এবং এর মধ্যে নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির সুযোগও রয়েছে। নতুন করে তিক্ততার পরিবর্তে ডোনাল্ড লুর সফরে যেহেতু ইতিবাচকতাই বৃদ্ধি পেয়েছে, তাই আশা করা যায় আমাদের গণতন্ত্রের উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বহাল থাকার সঙ্গে সঙ্গে আমরাও এখানে রাজনৈতিক সমঝোতার পরিবেশ আরও উন্নত করতে পারব। র্যাব যেভাবে কাজ করছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন সন্তুষ্ট হয়ে ভবিষ্যতে তাদের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে পারে বলেও আশাবাদ পোষণের কারণ আছে। এক্ষেত্রে মিস্টার লুর বক্তব্য বিকৃতভাবে উপস্থাপনের কোনো প্রয়োজন নেই। তিনি যা বলে গেছেন, তাতেই সরকার ও দেশের জন্য যথেষ্ট ইতিবাচক বার্তা রয়েছে। দেখেশুনে বরং এমনটাই মনে হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে কিছু ক্ষেত্রে যে শীতলতা তৈরি হয়েছিলÑ তাকে উষ্ণ করতেই ছিল এ সফর।
শুধু বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়েই তাদের আগ্রহ রয়েছে, সেটা তো নয়। এখানে চলমান উন্নয়নের দিকেও যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি রয়েছে। আমরা লক্ষ করি, সংবাদ সম্মেলনে রফতানি ক্ষেত্রে স্থগিত জিএসপি সুবিধার প্রসঙ্গ উঠলে মিস্টার লু কোনো রাখঢাক না করেই বলেন, বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হলে বাংলাদেশই অগ্রাধিকার পাবে। বিশেষত পোশাক খাতে বাংলাদেশের যে ভূমিকা ও অর্জন, তাতে এটি আমাদের প্রাপ্য স্বীকৃতিই বটে। আর বাংলাদেশ কোনো বিশেষ ছাড়ের বিনিময়ে এটা অর্জন করছে, সেটি বলারও সুযোগ নেই। ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি বা আইপিএসের মতো ক্লাবে যোগদানের বিষয়েও যতদূর জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো চাপ নেই বাংলাদেশের ওপর। তারা নিশ্চয়ই লক্ষ করছেন, বাংলাদেশ নিজস্ব স্বার্থ বহাল রেখে একটি ভারসাম্যপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে চাইছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়াসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর কোনোটির দিকে হেলে না পড়ে বাংলাদেশ তার সুবিধা ও স্বার্থ হাসিল করতে চায়, এটাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারের অবস্থান। কোনো নিষেধাজ্ঞা বা চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে চলার বিষয়েও যে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সেটা প্রমত্তা পদ্মার ওপর সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের ঘটনাতেই প্রমাণ হয়। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে, রোহিঙ্গা প্রশ্নে বিরল মানবিকতা প্রদর্শন করে এবং ইউক্রেন যুদ্ধে বিবদমান কোনো পক্ষে হেলে না পড়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনেও আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকা দেশের মর্যাদা বাড়িয়ে চলেছে। এদিকে বর্তমান জটিল অর্থনৈতিক সংকটে কাবু না হয়ে, বরং তা সামাল দিয়ে উন্নয়ন-অগ্রগতির পথে চলতেও আমরা সচেষ্ট আছি। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক ধারায় অগ্রসর হলে সেটা দু’দেশের জনগণের জন্যই কল্যাণকর হবে।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিক, লেখক ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর