রুদ্র অয়ন: তখনও গভীর রাত। ঘুম ভেঙে গেলো কল্পনার। বাইরে ঝড়ের প্রবল গোঙানির আওয়াজ!
আজ অনেকগুলো বছর কি যে হয়েছে ওর, ঘুমের ঔষধ না খেলে ঘুমুতে পারেনা। এঘর থেকে ওঘর পায়চারি করে বেড়ায়। ছটফট করে সারারাত! মনে হয় এই বাড়ির চার দেয়ালে কেউ যেনো তাকে বন্য পশু পাখির মতো বন্দি করে রেখেছে!
সবই তন্ময়ের জন্যে। বিনিদ্র রাতের যন্ত্রণা, কষ্ট এসবই তন্ময়ের জন্যে। প্রতিরাতে বাধ্য হয়ে কল্পনাকে ঘুমের ঔষধ খেতে হয়। ঘুম ছাড়াতো মানুষ বাঁচেনা। ছোট ছোট হলদে রঙের ট্যাবলেট। প্রথম প্রথম একটা ট্যাবলেটেই কাজ হতো, এরপর দাঁড়ালো দু’টোতে। এভাবে ক্রমশ এখন কখনো পাঁচটা, কখনো ছয়টায় দাঁড়িয়েছে! বলতে গেলে নেশাই বটে। কল্পনা তবু তন্ময়কে ভুলতে পারেনি। এখনও মাঝে মধ্যে আতর্কিতভাবে তন্ময় এসে কল্পনার সুপ্ত রাতের শান্তিকে অতীত স্মৃতির ধারালো ছুরি দিয়ে যেন টুকরো টুকরো করে দিয়ে যায়!
আসলে তন্ময় আসেনা, আসে শুধু তার স্বপ্ন। স্বপ্ন নয়, দুঃস্বপ্ন বলাটাই শ্রেয়। আর সে দুঃস্বপ্ন দেখে মাঝ রাতে জেগে ওঠে কল্পনা পায়চারি করে বেড়ায় এঘর ওঘর। কখনওবা উন্মাদের মতো চিৎকার করে ডাকে তন্ময়কে!
দিনের বেলায় কল্পনা কিন্তু সুস্থ- স্বাভাবিক মানুষ। অন্যান্যদের সাথে মিশে সারাদিনটা দিব্যি কাটিয়ে দেয়। স্কুলের শিক্ষকতার চাকুরী করে। সমস্যা হয় রাত হলে। সব কাজ যেনো শেষ হয়ে যায়! রাতের আঁধারের সাথে সাথে কল্পনাকে ঘিরে ধরে অস্বস্তিকর দুঃস্বপ্ন আর বিনিদ্র রাতের দুঃসহ বেদনা।
সহসা সদর দরজার কপাট দু’টো দুমদাম করে পেটানোর শব্দ শোনা গেলো! ভীষণ বিরক্তিবোধ হচ্ছে কল্পনার। বাইরে তুমুল ঝড় বইছে। এ সময় কে আবার এলো! ঝড়ের মধ্যে দরজা খুলতে ইচ্ছে করছেনা তার। একটুক্ষণ পরে দূর থেকে ভেসে এলো পোঁঝিক ঝিক শব্দে রেলগাড়ীর আওয়াজ। কল্পনার মাথায় বিদ্যূতের মতো একটা ভাবনা খেলে গেলো! কয়েক দিনের মধ্যে ওর দূর সম্পর্কের বোনের আসার কথা গ্রামের বাড়ি থেকে। স্বামীকে নিয়ে বেড়াতে আসার কথা। যদি তারা এসে থাকে? ছি,ছি ঝড়ের মধ্যে তাদের এভাবে এতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখা ঠিক হয়নি।
বিছানা ছেড়ে ওঠে পড়লো কল্পনা। টেবিলের ওপর থেকে টর্চ লাইট নিলো। এরপর বারান্দা পেরিয়ে সদর দরজার কপাট দু’টো খুলে টর্চের আলোয় যা দেখা গেলো, তাতে নিজের চোখকেও বিশ্বাস হয়না!
না, ওর দূর সম্পর্কের বোন নয়। ঝড়ে ওড়া শুকনো পাতায় বিপর্যস্ত এক যুবক! মাথায় বিয়ের মুকুট, গায়ে শেরওয়ানী! কল্পনার মাথায় তালগোল পাকিয়ে যায়! কি বলবে আর কি করবে ভেবে ওঠার আগেই যুবকটি বলে ওঠলো, ‘ভেতরে যেতে দেবে না নাকি?’
কল্পনা দ্বার ছেড়ে দাঁড়াতেই যুবকটি পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো। আর সেই বহুদিনের পরিচিত গলার আওয়াজে ছ্যাঁৎ করে ওঠলো কল্পনার বুকের ভেতরটা!
সদর দরজা খোলা রেখেই ঘরে ফিরে এলো কল্পনা। হ্যাঁ, তন্ময়ই এসেছে বটে! কিন্তু একি বেশভূষা তার! একি তন্ময়, নাকি কোনও জীবন্ত দেবোতা! এ কোন তন্ময়! বিয়ের সাজ! হাতে মালা!
ঘরে সোফায় বসে পড়লো তন্ময়। বিয়ের মুকুটটা খুলে পাশে রাখলো। মুখে হাসি এনে চাপা গলায় বললো, ‘কিছু বলছো না যে! চিনতে পারছোনা না কি আমাকে?
কল্পনার যেনো চেতনা ফিরে এলো। মৃদু স্বরে প্রশ্ন করলো, ‘হঠাৎ এলে যে?’
– হুম।
: কিন্তু এমন সাজ কেন তোমার?’
– এটা কিসের সাজ জানো না?
: জানি। বিয়ের সাজ।
– জানো তো প্রশ্ন করলে কেন? বোধকরি বুঝে ফেলেছো আজ আমার বিয়ে।’
: বিয়ে! আর তুমি এখানে?
– বিয়ে করবো বলেইতো এখানে এসেছি।
কল্পনা বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেলো! তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে ওর মাথায়! বিস্ময়ের কণ্ঠে কল্পনা বলে, ‘কি বলছো এসব তুমি! বিয়ে! এখানে! কার সাথে?’
কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে হেসে ওঠে তন্ময়। এরপর হাসি থামিয়ে শান্ত স্বরে বললো, ‘তন্ময়ের বিয়ে কার সাথে হতে পারে?’
: আমি কি জানি!
– তুমি জানো কল্পনা, জানো বৈকি। দুনিয়াতে তুমি ছাড়া আর কেউ জানেনা।
কল্পনার বিস্ময়ের ঘোর বেড়েই চলেছে! অস্থির কণ্ঠে বললো, ‘বিধাতা অথবা শয়তান – যে কোনও একজনের দোহাই তোমার, সত্য করে বলো; তোমার বিয়ে কার সাথে! কে সে?’
মৃদু হেসে তন্ময় বললো, ‘সে কল্পনা ছাড়া আর কেউ নয়।’
তন্ময়ের কথা শোনা মাত্রই মনে হলো আগুনের গোলা কে যেনো ওর বুকে ছুঁড়ে মারলো! বহুকষ্টে সে আঘাত সামলে নিলো। এরপর বিস্ময় কণ্ঠে বললো, ‘তুমি সত্যিই কি তন্ময়। নাকি অন্য কেউ?’
তন্ময় মুখে হাসি এনে শান্ত কণ্ঠে বললো, ‘ভীষণ অবাক হয়ে গেছো দেখছি! তা অবশ্য হবারই কথা।’
মুক্তিযোদ্ধা তন্ময় প্রতিজ্ঞা করেছিলো, দেশ স্বাধীন না হলে ঘরে ফিরবেনা। সে তন্ময় এতদিন পর খুঁজে খুঁজে কল্পনার ঠিকানা সংগ্রহ করে তার কাছে ছুটে আসবে; যে কল্পনাকে কথা দিয়ে বলেছিলো, ‘অপেক্ষা করো, আমি আবার ফিরে আসবো।’
কল্পনার চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলেছিলো, ‘কেঁদোনা প্রিয়তমা, তুমি দেখো দেশমাতাকে স্বাধীন করে আমি ঠিক ফিরে আসবো। তোমার ভালোবাসা আমাকে আবার তোমার কাছে ফিরিয়ে আনবে।’
সেই মুক্তিযোদ্ধা তন্ময় এতোগুলো বছরপর ছুটে আসবে তার প্রেয়সীর কাছে, ভাবাই যায়না!
তন্ময়ের চোখে চোখ রেখে কল্পনার ঘোলাটে দৃষ্টিও স্বচ্ছ হয়ে আসছে। হ্যাঁ, এইতো সেই তন্ময়। একান্তরে যে ছেলেটা শপথ করেছিলো, দেশমাতাকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীনতায় পতাকা হাতে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে এসেই কল্পনাকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করবে। হ্যাঁ, এবার চিনতে পেরেছে কল্পনা। আর কোনও সংশয় নেই তার। হারানো তন্ময় ফিরে এসেছে! কিন্তু একি তন্ময়ের আসার সময়! স্বাধীনতার এতোগুলো বছরপর, প্রলয় ঝড়ের মাঝে; এই কি প্রিয়জনের অভিসারলগ্ন!
তন্ময় কাছে এসে একটি হাত কল্পনার কাঁধে রেখে বললো, ‘শুনছো? রাত যে আর বাকী নেই। সৃষ্টিকর্তাকে সাক্ষী রেখে বিয়েটা আজ সেরে ফেলি।’
কল্পনার চোখে উদ্বেগ দেখা দিলো। আশ্চর্য! একি সৃষ্টি ছাড়া খেয়াল তন্ময়ের! কল্পনা আপত্তি জানিয়ে বললো, ‘আজ থাক। রাত অনেক ; বাইরে ভীষণ ঝড়। বরং কালকে……।’
অসহিষ্ণু কণ্ঠে তন্ময় বললো, ‘ভয় নেই গো। বিধাতার কৃপায় কোনও বিপদ হবেনা। দু’জন দু’জনকে মন থেকে গ্রহণ করে সৃষ্টিকর্তাকে সাক্ষী রেখে মালা পরিয়ে দেবো, সেই হবে আমাদের বিয়ে।’
তন্ময় কল্পনাকে ধরে দাঁড় করালো। এরপর খোলা দরজায় আকাশের দিকে দৃষ্টি করে বিধাতার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বললো, ‘সাক্ষী থেকো সৃষ্টিকর্তা, আজ থেকে কল্পনা আমার স্ত্রী, আমি ওর স্বামী।’
এরপর হাতের মালাটি কল্পনার গলায় পরিয়ে দিলো। কল্পনা পরক্ষণে সেই মালাটি তন্ময়ের গলায় পরিয়ে দিয়ে বললো, ‘সাক্ষী রইলো বিধাতা, আজ থেকে তুমিই আমার স্বামী, আমি তোমারই স্ত্রী।’
কল্পনা হাটু গেড়ে বসে পড়লো স্বামীর চরণ ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিতে।
তখন ঝড় থেমে গেছে। সকাল হতে আর বাকী নেই। দূর থেকে মোরগের ডাক ভেসে আসছে।
পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিয়ে মাথা তুললো কল্পনা। সামনে তাকিয়েই ভীষণভাবে চমকে গেলো সে! বুকের ভেতর অসম্ভব রকম ভূ-কম্পনের মতো একবার কেঁপে ওঠেই যেনো স্থির হয়ে গেলো! আশ্চর্য! তন্ময় গেলো কোথায়! আর সদ্য বিবাহিত বউকে ফেলে কেনোই বা যাবে?
কল্পনা চিৎকার করে ডাকলো- তন্ময়….
কোনও সাড়া শব্দ নেই। আবার ডাকলো। আরও একবার ডাকলো। সেই ডাকে পাখা ঝেড়ে ওঠলো শেষ রাতের নিশাচর পাখি। দূর থেকে শোনা গেলো শকুন শিশুর কান্না!
তন্ময়….. তন্ময়….. করে ডাকতে ডাকতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো কল্পনা। পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে এক সময় একটা অশ্বত্থ গাছে কলাপটা সজোরে ঠুকে গেলো। তারপর আর কিছু মনে নেই।
যখন কল্পনার জ্ঞান ফিরলো, তখন দেখে সে তার বাড়ির বিছানায় শুয়ে রয়েছে। বাড়ির কাজের মেয়ে তাকে বাইরে জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে এনেছে। কিন্তু তন্ময় গেলো কোথায়! গত রাতের ঘটনাটার সবটাই কি একটা দুঃস্বপ্ন! একাত্তরে যুদ্ধে গিয়েছিলো তন্ময়। দেশ স্বাধীন করে তবেই ঘরে ফিরবে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও তন্ময়কে যুদ্ধে যেতে বাঁধা দেয়নি কল্পনা। দেশমাতার চেয়ে, দেশের স্বার্থের চেয়ে বড় কিছুই হতে পারেনা একজন দেশপ্রেমিক মানুষের কাছে। তন্ময় কল্পনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যুদ্ধে চলে যায়। এরপর যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে খবর আসে তন্ময় নিহত হয়েছে।
সবটাই তাহলে চোখের ভুল। অনিদ্রা- রোগগ্রস্ত কল্পনার স্বপ্ন বিকার! তন্ময় আসেনি। মৃত মানুষ কখনও আসেনা।