মোনায়েম সরকার: আমেরিকা বিশ্বের সুপার পাওয়ার দেশ। বিশ্বে এমন কোনো রাষ্ট্র নেই, যে রাষ্ট্র আমেরিকাকে সমীহ করে না। আমেরিকার ষড়যন্ত্র, ক্ষমতা ও অস্ত্রবাজিকে ভয় পায় না। সমগ্র পৃথিবীতেই আমেরিকা একটি আতঙ্কের নাম। আমেরিকার মিথ্যাচার ও নিপুণ ষড়যন্ত্রের কথা ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা আছে। সা¤্রাজ্যবাদী আমেরিকা পরধন লোভের বশে সারাবিশ্বে যুদ্ধ ছড়িয়ে দেওয়ার অভিনব কৌশল এঁটেছে। আরব বসন্তের নামে পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে তা-ব চালিয়ে অসংখ্য মানুষ হত্যা করেছে। গাদ্দাফি, সাদ্দাম হোসেনকে শুধু নিহতই করেননি, তাদের পুরো পরিবার তছনছ করে দিয়েছে। মার্কিন ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদ। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা যে আগুন লাগিয়েছিল, সে আগুনের তাপ শেষ হতে না হতেই ইউরোপ জুড়ে আবার জ্বলে উঠেছে ভয়ঙ্কর যুদ্ধের লেলিহান শিখা। আমেরিকার কোনো চরিত্র নেই, সে চেনে শুধু টাকা, তার কাজ হলো লুন্ঠন। এই লুণ্ঠনের সুবিধার্থে সে দেশে দেশে সামরিক শাসন আনে। এক সময় পৃথিবীর ৭০টির মতো দেশে আমেরিকার ষড়যন্ত্রে সামরিক শাসন ছিল। এখনো যেসব রাষ্ট্রে সামরিক শাসন আছে, সেখানেও আছে আমেরিকার হাত। টাকা আর সম্পদের লোভে পৃথিবীকে অস্থির করার জন্য আমেরিকা যেভাবে উঠে পড়ে লেগেছে, তাতে মনে হচ্ছে সেদিন বেশি দূরে না যেদিন সমগ্র বিশ্ব এক সাথে বলে উঠবেÑ ‘লড়াকু মানুষ জেগে ওঠো, আমেরিকার তা-ব থামাও, পৃথিবী বাঁচাও।’
ন্যাটোর কাঁধে চড়ে আমেরিকা অনেক দেশ সর্বস্বাস্ত করেছে। এশিয়ার দেশগুলো যেভাবে একের পর এক ধ্বংস করেছে, তার সহিংসতা ও নির্মমতা চেঙ্গিস খান কিংবা হালাকু খানকেও হার মানিয়েছে। তারা চায় পৃথিবীর সবদেশ তাদের কথায় উঠবস করবে। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের ঘটনা পুরো পৃথিবীতে আমেরিকার মুখোশ খুলে দিয়েছে। এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে প্রতিদিনই দর্পচূর্ণ হচ্ছে আমেরিকার। যুদ্ধের মাঠে ইউক্রেনকে দেখা গেলেও ইউক্রেনের পেছনে যুদ্ধ করছে আমেরিকা। ইউক্রেন যুদ্ধ এখন পর্যন্ত টিকে আছে আমেরিকার কূটচাল ও অপশক্তি প্রদর্শনের জন্য। রাশিয়া একের পর এক ইউক্রেনীয় অঞ্চল দখলে নিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেÑ ছায়া যুদ্ধ খেলে আমেরিকা সুবিধা করা তো দূরের কথা, বাস্তব যুদ্ধেও রাশিয়া আমেরিকাকে ছেড়ে কথা বলবে না। রাশিয়ার সঙ্গে সুর মিলিয়েছে বিশ্বের আরো অনেক দেশ। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকদের ধারণা এই যুদ্ধে আমেরিকা সংযত না হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছেন আমেরিকার বিরুদ্ধে। এমনকি প্রয়োজনে রাশিয়া পারমাণবিক বোমা ফাটাতেও দ্বিধা করবে না, পুতিনের আগ্রাসী মনোভাব আমেরিকা বুঝতে পেরে দেশে দেশে দৌঁড়ঝাঁপ শুরু করেছে এবং যাকে যেভাবে পারছে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছে। ইতিহাসে দেখছি, আমেরিকার সাথে যারা অন্ধকারে হাত মিলিয়েছে তারা শেষ হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। আর যারা বুক ফুলিয়ে আমেরিকাকে রুখে দাঁড়িয়েছে তারাই বিজয়ী হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ভিয়েতনাম, কিউবা অথবা বলিভিয়ার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। এমনকি বাংলাদেশের দৃষ্টান্ত দিলেও বোধহয় বেমানান লাগবে না।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমরা দেখেছি কিভাবে পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক সামরিক-আমলাতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারাকে আমেরিকা সমর্থন করেছে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিঘিœত করার জন্য অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছে এমনকি অন্যায়ভাবে সপ্তম নৌবহর পাঠানোর চেষ্টা করেছে যা প্রতিহত করেছে রাশিয়া। সা¤্রাজ্যবাদী আমেরিকার মাথায় তাদের সারাক্ষণ দুষ্টুবুদ্ধি খেলা করে। এরা একদিকে গণহারে মুসলমান হত্যা করে, আবার অন্যদিকে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাকে জিইয়ে রাখার কৌশল অবলম্বন করে। তালেবান, আল-কায়েদা, আইএসÑ এসব তাদেরই সৃষ্টি। এক মুখে যে কতভাবে মিথ্যা কথা বলা যায়Ñ আমেরিকাকে না দেখলে কেউ তা বিশ্বাস করবে না।
আমেরিকা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি। তাই তারা বাংলাদেশের জন্মমুহূর্ত থেকেই বাংলাদেশকে নিয়ে নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে। বাংলাদেশে যতগুলো জাতীয় দুর্যোগ সংঘটিত হয়েছে তার সবগুলোর পেছনেই ছিল আমেরিকার গোপন ষড়যন্ত্র। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডি, জেলের মধ্যে জাতীয় চার নেতা হত্যা, ২১ আগস্টের গ্রেনেট হামলা, ১/১১-এর সেনা সমর্থিত ইয়াজউদ্দীন, ফখরুদ্দীন, মঈন ইউ আহমদের তথাকথিত পুতুল সরকারসহ সবখানেই রয়েছে আমেরিকার অলৌকিক চক্রান্তের ছাপ, কিন্তু এত কিছু করেও আমেরিকা বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। সব বাধা অতিক্রম করে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে তার উন্নতির শিখরে। বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষ বর্তমানে আমেরিকার অকারণ হস্তক্ষেপের ব্যাপারে যে শক্ত অবস্থান নিয়েছে তাতে মনে হচ্ছে বাংলাদেশে আমেরিকার মাতব্বরী করার সময় শেষ হয়ে আসছে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূতগণ যতটা না কূটনৈতিক তারচেয়ে অনেক বেশি ভূমিকা পালন করে গোয়েন্দা ও ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে। বাংলাদেশের সব বিষয় নিয়ে কথা বলার অধিকার আমেরিকার রাষ্ট্রদূত রাখেন না। তাদের সে অধিকার থাকা উচিতও নয়। আমেরিকায় নিযুক্ত বাংলাদেশের দূতাবাস কি আমেরিকান দূতাবাসের মতো আমেরিকাকে কারণে-অকারণে জ্ঞান দান করার অধিকার রাখে? নাকি বাংলাদেশের দূতাবাসকে সেই সুযোগ দেওয়া হয়? যদি তা-ই না হয় তাহলে আমেরিকার রাষ্ট্রদূতরা কেন আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে এত মাথা ঘামান?
আমরা বিগত দিনে ম্যারি অ্যান পিটার্স নামের আমেরিকান রাষ্ট্রদূতকে দেখেছিলাম বাংলাদেশের মসজিদের ইমামদের প্রশিক্ষণে হাফ স্কার্ট পরে হাজির হন ইমামদের ছবক দিতে। তিনি জামায়াত নেতাদের সঙ্গেও স্পেশাল স্কার্ট অর্থাৎ ফুল হাতা জামা পড়ে দেখা করেন এবং জামায়াতিদের ‘মডারেট ডেমোক্রেটিক মুসলিম’ বলে অভিহিত করেন। ইমাম সাহেবরা ও জামায়াত নেতারা সেদিন বেশ পুলক বোধ করেছিল মেরি এ্যান পিটার্সের কথায়। হ্যারি কে টমাস এসে তো পুরো দেশেই জঙ্গি-তৎপরতা ছড়িয়ে দিয়ে গেলেন। তিনি যে সকল রাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূতগিরি করেছেন সবখানেই নাকি যুদ্ধ ও গৃহযুদ্ধ বাঁধানোর ষড়যন্ত্র করেছেন। এরপরে দেখলাম ড্যান ডব্লিউ মজিনার ৬৪ জেলায় আকস্মিক সফর। তার এই ভ্রমণের মানে কি বাংলাদেশ প্রেম? মোটেই তা নয়। যে আমেরিকা কোনো দিনই বাংলাদেশের মঙ্গল চায় না, তার রাষ্ট্রদূত যখন দেশের ৬৪টি জেলা ভ্রমণ করেন তখন বুঝতে হবে তিনি বাংলাদেশের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এই ক্লেশকর ভ্রমণ করেননি, তিনি ভ্রমণ করেছিলেন সবকিছু সরেজমিনে গিয়ে দেখতে ও চক্রান্তের জাল বিস্তার করতে।
বিগত দিনে আমেরিকা বাংলাদেশকে নিয়ে অনেক খেলা খেলেছে, এখনও খেলছে। বাংলাদেশবিরোধী শিবিরে গিয়ে সে এখন নির্বাচন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কথা বলছে। বাংলাদেশে দুই-একটি অনাকাক্সিক্ষত হত্যাকা- ঘটলে আমেরিকা হৈচৈ করে। অথচ আমেরিকাতে এমন কোনো দিন নেই যেদিন এ রকম হত্যাকা- না ঘটে। ওদের স্কুলগুলোতে কোমলমতি শিশুদের গুলি করে হত্যা করা হয় কৃষ্ণাঙ্গদের মারা হয়; কিন্তু এরপরেও বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বা নিরাপত্তা নিয়ে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত কথা বললে সেটা বাংলাদেশের জন্য মর্মপীড়ার কারণ হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ আমেরিকার চেয়ে সভ্য।
বাংলাদেশের সাধারণ নিরীহ মানুষ আমেরিকা যেতে চাইলে ভোগান্তি ও ভিসা ফি গুণে গুণে শেষ। অথচ বঙ্গবন্ধুর ঘাতকসহ দেশবিরোধী কর্মকা-ে লিপ্ত অনেক ক্রিমিন্যাল ঠিকই বহাল তবিয়তে আছে আমেরিকায়। বাংলাদেশের ভালো মানুষেরা আমেরিকার ভিসা পায় না কিন্তু খুনিরা, ক্রিমিন্যালরা ঠিকই আমেরিকার ভিসা পায়Ñ এগুলো খুব ভালো আচরণ নয়।
পৃথিবী প্রতি মুহূর্তেই পরিবর্তিত হচ্ছে। একদিন কেউ আর আটলান্টিক মহাসাগর পার হতে চাইবে না। বিগত দুটি বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার গায়ে কোন আঁচড় লাগেনি। আমেরিকা আজ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধানোর পাঁয়তারা করছে। সেই যুদ্ধে আমেরিকা নিজেরাই প্রথম ধ্বংস হবে। কারণ সমগ্র পৃথিবীকে ক্ষেপিয়ে পৃথিবীর সব দেশকে শত্রুদেশে পরিণত করে আমেরিকা একা ভালো থাকতে পারবে না।
আজ আমেরিকার ভাবার সময় এসেছে, তাদের বিরোধিতা স্বত্ত্বেও বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, তাদের ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করেও পদ্মা সেতু নির্মিত হয়েছে। সুতরাং বাংলাদেশে নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূতদের কোড অব কন্ডাক্ট মেনে আচরণ করতে অনুরোধ করছি। বাংলাদেশ কারো হাতের পুতুল নয়। এদেশের মানুষ জননেত্রী শেখ হাসিনার সুদৃঢ় নেতৃত্ব বুঝে ফেলেছে কিসে তাদের মঙ্গল। বাংলাদেশ শুধু নয়, বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মাথা ঘামানো আমেরিকার বন্ধ করতে হবে। তা না হলে হয়তো যেকোনো সময় আমেরিকার নিজের মাথাটাই কাটা যেতে পারে। সমগ্র বিশ্ব আমেরিকার বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে। আজ তারা ক্রমে ক্রমে বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে। মিত্র রাষ্ট্রের ক্ষতি করে নিজের উন্নতি করতে চাইলে সা¤্রাজ্যবাদী আমেরিকার পাশে কেউ থাকবে না। আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করে বিশ্বে নতুন শক্তির উদয় হচ্ছে। নতুন দিনের শুভলগ্নে আমেরিকাকে পাশবিক আচরণ পরিহার করে মানবিক হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে গোটা বিশ্ব। আশা করি আমেরিকা মুখে মুখে মানবতা ও গণতন্ত্রের কথা না বলে সত্যি সত্যি ওই পথে হাঁটবে।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।