মোনায়েম সরকার: পৃথিবী মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। মানুষের সীমাহীন অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে বিশ্ব প্রকৃতি। প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার ফলে মানুষ ও পরিবেশের সঙ্গে প্রকৃতি বিমাতাসুলভ আচরণ করছে দীর্ঘদিন যাবৎ। প্রকৃতি বিজ্ঞানীরা বহুকাল আগে থেকেই সতর্কবাণী উচ্চারণ করে আসছেন প্রকৃতির বিরূপ আচরণ নিয়ে, সেসব সতর্কবাণী কর্ণপাত না করার কারণে পৃথিবীর কোনো কোনো অঞ্চল বিশেষ করে আফ্রিকা মহাদেশের দরিদ্র রাষ্ট্রগুলো খরায় পুড়ে তামা হয়ে যাচ্ছে। কোনো অঞ্চলে দেখা দিচ্ছে আকস্মিক বন্যা। দাবানলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে কোনো কোনো অঞ্চলের বিস্তীর্ণ শ্যামল ভূমি। এসব ভয়ঙ্কর বিপর্যয় দেখেও যে মানুষ সাবধান হচ্ছে বিষয়টি এমন নয়। বরং আগের মতোই নির্বিচারে বন-বনানী উজাড় করে, পাহাড় কেটে, নদীতে বাধ দিয়ে ক্রমাগত প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণ করছে। এর পরিণাম কী ভয়াবহ হবে, তা আজ কিছুটা হলেও সবাই অনুমান করতে পারছি।
মানুষ প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতির আদর জড়ানো কোলেই মানুষ বেড়ে ওঠে। প্রকৃতি বিরূপ হলে মানুষের জীবনও তাই হুমকির মুখে পড়ে। প্রকৃতি সর্বংসহা। সহজেই সে কোনো প্রতিশোধ নেয় না। মানুষের সীমাহীন অত্যাচারে প্রকৃতি যখন দিশেহারা হয়ে যায় তখনিই সে হিং¯্র হয়ে ওঠে। তা-বনৃত্যে ধ্বংস করতে উদ্যত হয় মানুষের বসতবাড়ি, শহর-বন্দর, সভ্যতা। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে আছে প্রকৃতির প্রতিশোধের অজ¯্র কাহিনী। সে সব কাহিনী পড়ে বর্তমান যুগের মানুষ সংশোধন না হয়ে, আরো যেন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে হার-না-মানা প্রকৃতিকে বশ করার জন্য। মানুষের শক্তি সীমিত, কিন্তু প্রকৃতির শক্তি অসীম। এই অসীম শক্তিকে সীমিত শক্তি দিয়ে বশ করা যাবে না এই কথাটি আজ সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে।
জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব সারা পৃথিবীতেই কমবেশি পড়তে শুরু করেছে। উন্নত বিশ্বের অধিবাসীগণ নিজেদের জীবনকে উপভোগ করতে গিয়ে নির্বিচারে দূষিত করেছে বায়ুম-ল। বায়ুম-লের ওজন স্তরে অনেক আগে থেকেই ছিদ্র দেখেছিলেন প্রকৃতি বিজ্ঞানীগণ। সেই ছিদ্র ক্রমে ক্রমে বড় হচ্ছে। এর ফলে সূর্যের তাপ সহজেই চলে আসছে পৃথিবীর বুকে। সূর্যের তাপে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে ভূমিপৃষ্ঠ। পৃথিবীর দুই মেরুতে জমে থাকা বরফ গলছে লাগামহীনভাবে। দক্ষিণ মেরুর বরফ গলে ইতোমধ্যে সাগর-মহাসাগরের উচ্চতা বেড়েছে বিস্ময়করভাবে। এভাবে সাগরের পানি বাড়তে থাকলে সমগ্র ভূখ- অচিরেই পানির নিচে তলিয়ে যাবে।
এমনিতেই পৃথিবীর তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থল। পুঞ্জীভূত বরফ গলে গলে এই জলের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে স্থলের অস্তিত্ব বিলীন হবে, এই সত্যটুকু উপলব্ধি করার জন্য গভীর জ্ঞানের দরকার নেই। একটুখানি বুদ্ধি খাটিয়ে হিসাব-নিকাশ করলেই বিষয়টি পরিষ্কার বোঝা যায়। জলবায়ু দূষণের ফলে শুধু মানুষেরই সমস্যা হচ্ছে তা-ই নয়, জীববৈচিত্র্যও হুমকির মুখে পড়েছে। পৃথিবীর অনেক প্রাণিই ইতোমধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। আরো অনেক প্রজাতির প্রাণি বিলীনের অপেক্ষায় প্রহর গুণছে। জীববৈচিত্র্য তখনই ধ্বংস হয় যখন জলবায়ুর দূষণের মাত্রা সীমা অতিক্রম করে। বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে কোটি কোটি টন ই-বর্জ্য জলবায়ুর উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় মানুষকে আরো বেশি সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রকৃতি-বিজ্ঞানীরা। সতর্কবার্তা শোনার পরও ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় তেমন কোনো সুপরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না।
চলতি বছরে পৃথিবীর অনেক দেশেই অস্বাভাবিক বন্যা দেখা যাচ্ছে। আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীনসহ অসংখ্য দেশ আকস্মিক বন্যায় ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশের সিলেট বিভাগ পুরোটাই চলে যায় পানির নিচে। আসাম থেকে ধেয়ে আসা বৃষ্টির পানিতে এই বন্যা সৃষ্টি করেছে বলে আবহাওয়াবিদদের ধারণা। ভারতের চেরাপুঞ্জিতে এবার এত পরিমাণ বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়, যা একশ বিশ বছরের মধ্যে হয়নি। অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে শুধু সিলেট বিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে তাই নয়, সিলেটের পানি নেমে যাওয়ার সময় অন্যান্য অঞ্চলও বন্যা প্লাবিত হবে। ঘরবাড়ি, লোকালয় পানির নিচে তলিয়ে যাবে। গবাদি পশু, ক্ষেতের শস্য ইত্যাদিও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এক অঞ্চলের জলবায়ু দূষিত হলে অন্য অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হবে না এমনটি ভাবার কারণ নেই। এক দেশের বৃষ্টির পানি আরেক দেশে বন্যা সৃষ্টি করতে সক্ষম হলে এক দেশের দূষণও অন্য দেশের ক্ষতির কারণ হতে পারে।
বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই জলবায়ু সচেতন। বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে তিনি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের বিভিন্ন ফোরামে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছেন। জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্ব নেতাদের করণীয় সম্পর্কে তিনি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবসমূহ উত্থাপন করে বিশ্ব পরিবেশবাদী সংগঠনসমূহের পক্ষ থেকে অভিনন্দিত হচ্ছেন। জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাব মোতাবেক উন্নত বিশ্ব এ বিষয়ে আন্তরিকভাবে এগিয়ে এলে কিছুটা হলেও জলবায়ু দূষণ কমানো যেতে পারে।
বর্তমান বিশ্ব অসংখ্য সংকট নিয়েই একবিংশ শতক অতিক্রম করছে। করোনা মহামারী, দেশে দেশে যুদ্ধ, বন্যা-দাবানল-জলোচ্ছ্বাস-ঝড় সারা পৃথিবীকেই অস্থির করে তুলেছে। একটি সংকট শেষ হতে না হতেই আরেকটি সংকট এসে হাজির হচ্ছে বিশ্ববাসীর সামনে। অধিক জনসংখ্যার জন্য খাদ্যশস্য উৎপাদন করতে গিয়ে কীটনাশকের ব্যবহার, আসবাবপত্র তৈরির জন্য বন-উজাড়, ইটভাটা, ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল চুল্লি থেকে নির্গত কালো ধোয়া তিল তিল করে মানুষকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি যুদ্ধেই এখন উন্নত মানের অস্ত্র ব্যবহার করছে যুদ্ধে জড়িত রাষ্ট্রগুলো। যুদ্ধে ব্যবহৃত বোমা-কামানের গোলা থেকে নির্গত রাসায়নিক কেমিক্যাল একই সঙ্গে মানুষ ও প্রকৃতি দুটোরই ক্ষতি করছে।
নানাবিধ দূষণে জর্জর পৃথিবী কিভাবে ইঞ্চি ইঞ্চি করে সমুদ্রের জল গ্রাস করছে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন পরিবেশ বিজ্ঞানীগণ। আমরা এখনই যদি এ বিষয়ে সতর্ক না হইÑ তাহলে হজরত নূহ (আ.)-এর সময়ে যেভাবে পৃথিবী জলমগ্ন হয়েছিল সেভাবেই হয়তো সমগ্র পৃথিবী পানির নিচে তলিয়ে যাবে। পত্র-পত্রিকায় দেখছি মালদ্বীপের মতো আরো যত দ্বীপরাষ্ট্র আছে সেগুলো আছে চরম হুমকির মুখে। মালদ্বীপ তাঁর অধিবাসীদের জন্য উপযুক্ত ভূমির অনুসন্ধান করছে। বিশ্বের এমন সংকটজনক পরিস্থিতিতে বিশ্ব বিবেককে আরো বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। এক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোকেই সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের উপরেই নির্ভর করছে সবকিছু। ধনীদের সৃষ্ট জলবায়ু দূষণে শুধু গরিবরা মরবে না, ধনীরাও মারা যাবেÑ এটা তারা যত দ্রুত বুঝতে পারবে ততই পৃথিবীর মঙ্গল।
আমি পরিবেশ বিজ্ঞানী না হলে দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারি, আসলেই পৃথিবী অস্বাভাবিক আচরণ করছে। আমরা ছোটবেলায় শীতকালে বৃষ্টি দেখিনি, কিন্তু এখন দেখছি। চৈত্র মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই আগে কালবৈশাখীর প্রস্তুতি টের পেতাম। কিন্তু এখন বৈশাখ মাসেও বজ্রসহ কালবৈশাখী খুব একটা চোখে পড়ে না। আগে ঋতুতে ঋতুতে পার্থক্য বোঝা যেত, এখন সে পার্থক্য প্রকৃতি দেখে বোঝা যায় না, ক্যালেন্ডার দেখে বুঝে নিতে হয়। এই পরিবর্তন আমাদের মতো কৃষিভিত্তিক রাষ্ট্রের জন্য কী নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তা কৃষিবিদগণ ভালো বলতে পারবেন।
বিশ্বব্যাপী দৃষ্টি দিলে উপলব্ধি করা যায় পৃথিবীর মানুষ একটি নতুন আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট প্রত্যাশা করছে। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আজকের সব রাষ্ট্রনায়ককে শুধু মানুষের কল্যাণের কথাই ভাবতে হবে। বিশ্বায়নের যুগে দাঁড়িয়ে শুধু নিজের দেশ আর নিজের মানুষের কথা ভাবলেই চলবে না, পৃথিবীর সব মানুষকেই আপন বলে ভাবতে হবে। যে কোনো মানুষের কষ্টই সব মানুষের কষ্ট এই কথা যেদিন আমরা ভাবতে পারব সেদিনই বৈশ্বিক জলবায়ু নিয়ে সোচ্চার হবে সমগ্র বিশ্ব। মৃত্যুর কিনারায় দাঁড়িয়ে জীবনের জয়গান না গেয়ে সময় থাকতেই অশান্ত জলবায়ুকে শান্ত করতে হবে, বাঁচাতে হবে জীববৈচিত্র্য ও মানব সভ্যতা।
মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।