মোনায়েম সরকার: বিশ্বে যুদ্ধের পক্ষে যেমন কিছু যুদ্ধবাজ লোক আছে, তেমনি শান্তির পক্ষেও আছেন কিছু মানবদরদি মহামানব। এরা সব সময়ই শান্তির স্বপক্ষে লড়াই করে গেছেন। কিভাবে মানুষের জীবনকে সুস্থ-সুন্দর-যুদ্ধবিমুখ করা যায় তার জন্য এরা সারাজীবন কাজ করে গেছেন। এমনি একজন শান্তিকামী মানুষের নাম জঁ ফ্রেদেরিক জুলিও-ক্যুরি। জুলিও-ক্যুরির জন্ম ১৯ মার্চ, ১৯০০ সালে এবং তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ১৪ জুলাই ১৯৫৮ সালে। ফ্রান্সের প্যারিসে জন্মগ্রহণকারী জুলিও-ক্যুরি ছিলেন বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী। তিনি এবং তার স্ত্রী আইরিন জুলিও-ক্যুরি যৌথভাবে কৃত্রিম তেজস্ক্রিয় পদার্থ আবিষ্কারের ফলে ১৯৩৫ সালে রসায়নশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
বিশ্ববাসী আজ যে জুলিও-ক্যুরিকে চেনে, তার আসল পরিচয় পেতে হলে আমাদের যেতে হবে আরো একটু পেছনে, মারি ক্যুরির কাছে। কেননা এই মারি ক্যুরিরই ছাত্র ছিলেন জুলিও-ক্যুরি। মারি ক্যুরি ১৮৬৭ সালের ৭ নভেম্বর পোল্যান্ডের ওয়ার্সতে জন্মগ্রহণ করেন। মারি ক্যুরির সময়ে তার জন্মভূমি পোল্যান্ড ছিল রাশিয়ার সাম্রাজ্যের অংশ। মারি ক্যুরি কিছুকাল পর্যন্ত পোল্যান্ডেই লেখাপড়া করেন এবং ব্যবহারিক বিজ্ঞান বিষয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করেন। ১৮৯১ সালে ২৪ বছর বয়সে তিনি তার বড় বোন ব্রোনিস্লাভাকে অনুসরণ করে প্যারিসে পড়তে যান। প্যারিসে এসেই তিনি সংস্পর্শে আসেন বিশিষ্ট পদার্থবিদ পিয়েরে ক্যুরির। ১৮৯৫ সালের ২৬ জুলাই সেকাউক্সে (সেইনে) তারা দুজন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। মারি ক্যুরি পৃথিবীর একমাত্র নারী বিজ্ঞানী যিনি একই সাথে পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়ন বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯০৩ সালে মারি ক্যুরি তার স্বামী পিয়েরে ক্যুরি এবং পদার্থবিদ হেনরি বেকেরেলের সঙ্গে পদার্থ বিদ্যায় এবং ১৯১১ সালে এককভাবে রসায়নে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। মারি ক্যুরি প্রথম যে মৌলটি আবিষ্কার করেন তাঁর জন্মভূমির নামানুসারে ঐ মৌলের নাম দেন ‘পোলনিয়াম’। মারি ক্যুরি তার পিতা-মাতার পঞ্চম এবং কনিষ্ঠ সন্তান ছিলেন। মারি ক্যুারির পিতাও পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন পড়াতেন। ১৯৩৪ সালে মহিয়সী এই নারী ফ্রান্সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ক্যুরি পরিবারই পৃথিবীর একমাত্র পরিবার যে পরিবারের সদস্যরা বারোবার নোবেল পুরস্কারের গৌরব অর্জন করেন উদ্ভাবনী প্রতিভার ভিত্তিতে। যদিও বর্তমান কালপর্বে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে অনেকটাই রাজনীতিক স্বার্থ রক্ষার তাগিদে। কয়েকজন যুদ্ধবাজ বিতর্কিত ব্যক্তিকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, যার ফলে নোবেল পুরস্কার তার অতীত ঐতিহ্য কিছুটা হলেও হারাতে বসেছে।
জুলিও-ক্যুরি প্যারিস বিজ্ঞান অনুষদে প্রভাষক থাকাকালীন তার স্ত্রীর সঙ্গে পরমাণুর গঠন সম্পর্কীয় গবেষণায় মনোনিবেশ করেন ঠিকই কিন্তু মানুষের জন্য তার সংবেদনশীল মনে সব সময়ই তিনি একটি আন্তরিক টান অনুভব করেছেন। ১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর আগ্রাসন তিনি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন এবং তাদের হিংস্রতা প্রতিরোধে নানা রকম চিন্তা-ভাবনা করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি গঠন করেন বিশ্ব শান্তি পরিষদ বা World Peace Council। বিশ্ব শান্তি পরিষদ একটি প্রগতিশীল, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, বেসরকারি সংস্থা। বিশ্ব শান্তি পরিষদ যাত্রা শুরু করে ১৯৪৯ সালে কিন্তু পদক প্রদান শুরু করে ১৯৫০ সাল থেকে, ১৯৫৮ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ফ্রেদেরিক জুলিও ক্যুরি বিশ্ব শান্তি পরিষদের নেতৃত্বে ছিলেন। তার জীবদ্দশায় শান্তি পদক Medal of Peace নামে প্রদান করা হলেও তার মৃত্যুর পরে ওই পদকের নাম রাখা হয় জুলিও-ক্যুরি শান্তি পদক বা Joliot-Curie Medal of Peace ।
এখানে উলে¬খ্য, স্নায়ু যুদ্ধের সময় বিশ্ব শান্তি পুরস্কারের বেশিরভাগ অর্থের অনুদান দিতো সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বিশ্ব শান্তি পুরস্কারে ভূষিত অনেক ব্যক্তিই লাভ করেছিলেন লেনিন শান্তি পুরস্কার যা সোভিয়েত সরকার কর্তৃক প্রদান করা হতো। ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৬৭ জন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বকে বিশ্ব শান্তি পরিষদ ‘শান্তি পদক’ প্রদান করে। শান্তি পদক প্রাপ্ত কয়েকজন হলেন, চেকোস্লোভাকিয়ার জুলিয়াস ফুচিক, স্পেনের পাবলো পিকাসো, চিলির পাবলো নেরুদা, আমেরিকার পল রবসন, তুরস্কের নাজিম হিকমত, আমেরিকার মার্টিন লুথার কিং, কিউবার ফিদেল ক্যাস্ত্রো, মিশরের গামাল আবদেল নাসের, চিলির সালভাদর আলিন্দে, বাংলাদেশের শেখ মুজিবুর রহমান, প্যালেস্টাইনের ইয়াসির আরাফাত, সোভিয়েত ইউনিয়নের লিওনিড ব্রেজনেভ, তাঞ্জানিয়ার জুলিয়াস নায়েরে প্রমুখ।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ব শান্তির এক অবিস্মরণীয় দূত। এই অকুতোভয় শান্তিকামী মানুষটির একক নেতৃত্বে বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভ করে। দীর্ঘ ২৩ বছর পশ্চিম পাকিস্তানের নানাবিধ বঞ্চনার শিকার বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পায় সার্বিক মুক্তির স্বাদ। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে জুলিও-ক্যুরি শান্তি পদকে ভূষিত হয়ে শুধু নিজের জন্যই সম্মান অর্জন করেননি, সেই সঙ্গে তিনি বাঙালি জাতিকেও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সারাজীবনের স্বপ্ন ছিল বাঙালি জাতির শান্তিময় সমৃদ্ধ জীবন। সেই লক্ষ্যেই তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে গেছেন। কিন্তু যেই বঙ্গবন্ধু শান্তির দূত হিসেবে বিশ্ববাসীর সামনে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড থেকেই বুঝা যায় পৃথিবীতে শান্তি এখনো সুদূর পরাহত। এই শান্তিহীন, অস্থির পৃথিবীতে শান্তি ফিরিয়ে আনতে গেলে দেশে দেশে আবার শান্তি সঙ্ঘ বা শান্তি পরিষদ গড়ে তোলা দরকার।
মানুষ শান্তিপ্রিয় জীব। শান্তির সন্ধানেই আদিম জনপদ থেকে এখনো পরিশ্রমণরত শান্তিসন্ধানী মানুষ। মানুষ যতই শান্তির খোঁজে ছুটছে, শান্তি যেন ততই অধরা হয়ে উঠছে মানুষের কাছে। মানুষ যেন কিছুতেই শান্তিকে বশ করতে পারছে না। আজ পৃথিবীতে ভোগ্যপণ্যের অভাব নেই, ইচ্ছে করলেই মানুষ চলে যেতে পারছে এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে, তবু মানুষ শান্তিকে চিরদিনের জন্য বাগে আনতে পারছে না। শান্তির সন্ধানে ছুটতে ছুটতে অশান্তির অগ্নিদহনই হয়ে উঠছে মানুষের ভাগ্যের পরিহাস।
মানুষ কবে সভ্যতার দিকে যাত্রা শুরু করেছে তার একটা কালিক হিসাব সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞান আমাদের কাছে সামনে হাজির করেছে। মানুষের সামনের দিকে এগিয়ে চলার গতি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেলেও সেই ছুটে চলা গতির সঙ্গে বেশ কিছু উটকো সংকটও কখনো কখনো যুক্ত হয়েছে। এই সংকটগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে মানুষের চলার গতিকে কিছুটা মন্থর, কিছুটা দিশেহারা করেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। মানুষ কোনোদিনই সমানগতিতে সামনের দিকে এগুতে পারেনি। নানাবিধ সমস্যা, কারণে-অকারণে মানুষকে জাপটে ধরেছে। পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের নিয়তি বার বার অশান্তির রথচক্রে রক্তাক্ত হয়েছে, পৃষ্ঠ হয়েছে। তবু মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়ে নতুন শপথে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে গেছে শান্তির মোহনায়। এখনও আমরা শান্তির সন্ধানেই ছুটছি। শান্তি নামের সুখ পাখিটি আমাদের মাঝে মাঝে দেখা দিলেও, আবার কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। অশান্তির হিংস্র শকুন ‘শান্তির পাখি’কে বার বার হত্যা করতে চাইছে। শান্তি নিহত হলে অশান্তির অত্যাচারে নরক হয়ে উঠবে পৃথিবী। সেই পৃথিবীর কথা মনে হলে অনেকের মতো আমিও আঁৎকে উঠি।
আমরা একটি সুন্দর পৃথিবীতে বাস করতে চাই। যেই সুন্দর, শান্তিময় পৃথিবীর স্বপ্নে বিভোর আমাদের দুই স্বপ্নমুগ্ধ আঁখি, সেই শান্তির পৃথিবী কেবলই অলীক বলে মনে হচ্ছে মানুষের কাছে। আজ চারপাশে দেখছি, মানুষের রক্তে আক্রোশ মেটাচ্ছে মানুষ, এক মানুষ আরেক মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়ে, তাকে সর্বশান্ত করছে, হত্যা করছে, ষড়যন্ত্র করে উৎখাত করছে ভিটে মাটি থেকে। পৃথিবীতে এখনো এক মানুষ আরেকজন মানুষকে পণ্য করার ঘৃণ্য মানসিকতা প্রদর্শন করছে। সভ্যতার চরম শিখরে অবস্থান করেও আজ মানুষ অশান্তিরই পূজা করছে। এর চেয়ে বেদনার আর কি হতে পারে?
পৃথিবীর শান্তিবাদী মানবসন্তানগণ যুগে যুগে শান্তির বাণী প্রচার করে মানুষকে শান্তির পথে আহŸান জানালেও স্বার্থমগ্ন মানুষ তাতে সর্বাত্মকভাবে সাড়া দেয়নি কিংবা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি, কিন্তু আজ আমরা পৃথিবীর যেদিকে তাকাই, সেদিকেই দেখি অশান্তির কালো মেঘ মানুষকে ধ্বংসের বজ্রধ্বনি শোনাচ্ছে। ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়া কিংবা বরফে ঢাকা এন্টার্কটিকা, সর্বত্রই আজ অশান্তির লেলিহান শিখা বিষধর কালফণীর মতো ফণা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।
বঙ্গবন্ধু প্রত্যক্ষ করেছিলেন, শোষক মানুষের স্বার্থের কারণে ভুলুন্ঠিত হচ্ছে শোষিত মানুষের শান্তি। ধনলোভী শোষকদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘দুনিয়া দুই শিবিরে বিভক্ত শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ বঙ্গবন্ধু যেমন করে যুদ্ধবাজ, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে শোষিত মানুষের অশান্তি, বঞ্চনা মুছে দিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছিলেন, তেমনিভাবে আমাদের সবাইকেই আজ শান্তির পক্ষে দাঁড়াতে হবে। মানুষকে শুধু বুদ্ধিমান করলেই সব সমস্যার সমাধান করা যাবে না, সেই সঙ্গে তাকে মনুষ্যত্বের শিক্ষাও দিতে হবে। মনুষ্যত্ববিহীন পুঁজিবাদী শিক্ষাই আজ শান্তির বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। একটি শোষণহীন, শান্তিপূর্ণ মানবিক বিশ্বব্যবস্থা গড়তে হলে বঙ্গবন্ধু ও শান্তিবাদী অন্যান্য মহামানবের নীতি-আদর্শই আমাদের গ্রহণ করতে হবে। মারণাস্ত্রের ব্যয়বহুল উৎপাদন বন্ধ করে সেই অর্থ খাদ্য উৎপাদন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো দরকারি খাতে বরাদ্দ করা দরকার। একদিকে করোনা মহামারী, অন্যদিকে শক্তিমান ইসরাইল, আমেরিকা, সৌদি আরবসহ অন্যান্য রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া অমানবিক যুদ্ধ, এই দুই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি এড়াতে হলে শান্তিকেই আমাদের পাথেয় করা দরকার। অশান্তিকে পরাজিত করে আবার আমাদের শান্তির সপক্ষে দাঁড়াতে হবে, আবার আমাদের ফিরে যেতে হবে শান্তিবাদী টলস্টয়ের কাছে, রবীন্দ্রনাথের কাছে, অহিংস মহাত্মা গান্ধীর কাছে। এদের মানবিক শিক্ষা ছাড়া আজ অশান্তির রক্তপিপাসা মেটানো যেন কিছুতেই সম্ভব নয়।
-মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।