রংপুর বাংলাদেশের রংপুর বিভাগের অন্যতম প্রধান শহর এবং ১৮৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রাচীনতম একটি পৌর কর্পোরেশন। রংপুর শহর ১৭৬৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিভাগীয় সদর দপ্তর হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৮৯০ সালে তৎকালীন পৌর কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান ডিমলার জমিদার বাড়ির রাজা জানকীবল্লভ সেন রংপুর শহরে জলাবদ্ধতা ও মশার ও ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব নিরসনে তার মা শ্যামাসুন্দরীর নামে যে খালটি পুনঃখনন করেন তাই আজকের শ্যামাসুন্দরীর নামে পরিচিত এবং তার দানকৃত বাগান বাড়ির জমিতে ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে আজকের পৌরসভা ভবনটি গড়ে ওঠে। বর্তমানে আয়তনে দ্বিতীয় রংপুর সিটি কর্পোরেশনের আয়তন ২০৫.৭০ বর্গ কি.মি.। রংপুর সাতশত বছরের ঐতিহ্য “শতরঞ্জি”, ” হাড়িভাঙা আম”,” তামাক” এর জন্য বিখ্যাত। রংপুরকে ” বাহের দেশ ” বলা হয়।
আসুন এবার দেখে নেই বাংলাদেশের রংপুরের কিছু স্থানের নামকরণের ইতিহাস :
১ ।
মডার্ন মোড় : ১৯৭৯ সালে রংপুর ক্যাডেট কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্যাডেট কলেজ হওয়ার আগে সেখানেই ছিল রংপুর রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল। ফলে ঐ স্থানের পরিচিতি ছিল মডেল স্কুল মোড় নামে। সেই মডেল স্কুল মোড়ই সময়ের পরিক্রমায় মডার্ন মোড় হয়ে গেছে। বিশেষ করে বাসের হেলপার-কনট্রাকটররা মডেল স্কুল মোড়কে প্রথমে মডেল মোড় এবং পরে মডার্ন বানিয়েছেন।
২। জাহাজ কোম্পানি মোড় : রংপুর নগরীর প্রাণকেন্দ্র ‘জাহাজ কোম্পানি মোড়’ এলাকা। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে জাহাজ কোম্পানি মোড়ের মিতালী রেস্টুরেন্ট থেকে বর্তমান জাহাজ কোম্পানি শপিং কমপ্লেক্সের মধ্যে ‘জাহাজ কোম্পানি’ নামে একটা বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ছিল। যার মালিক ছিলেন অবাঙ্গালী ধনাঢ্য ব্যবসায়ী রেজা সাহেব। ইলেকট্রনিক ও ষ্টেশনারী সামগ্রীর পাশাপাশি ঘড়ি, রেডিও, সাইকেল ইত্যাদি পাওয়া যেতো। ওই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানটির নামানুসারেই ঐ এলাকার নাম হয়ে গেছে ‘জাহাজ কোম্পানি মোড়’। জাহাজ কোম্পানি ছাড়া সেখানে ‘ক্যাশ কোম্পানি’ নামের আরও একটা বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ছিল।
৩ ।
মাহিগঞ্জ : পূর্বে রংপুর শহর ছিল মূলত মাহিগঞ্জে। একটি সূত্র মতে, প্রখ্যাত দরবেশ, সেনাপতি শাহ ইসমাইল গাজীর সমসাময়িককালে শাহজালাল জাহাগাসত বোখারি নামে একজন পীর সাহেব তৎকালের খরস্রোতা ইছামতী নদী দিয়ে মতস্যাকৃতির নৌকায় (মতান্তরে মাছের পিঠে) সওয়ার হয়ে এই এলাকায় আগমন করেন। মাছের মতস্যাকৃতির নৌকায় সওয়ার (মাহীসওয়ার) হয়ে পীর সাহেবের আগমনের কারণে উক্ত এলাকার নাম হয়েছে মাহিগঞ্জ। বর্তমানে মাহিগঞ্জে তাঁর মাজার বিদ্যমান। অপর এক তথ্য মতে ঘোড়াঘাটের ফৌজদার এবাদত খাঁ ১০৯৪ বঙ্গাব্দে (১৬৮৭ খ্রীঃ) রংপুর দখল করে প্রথমে সদ্যপুস্করনী এলাকায় ঘাঁটি গাড়েন। পরে সেখান থেকে আট মাইলে উত্তরে এগিয়ে মাহীগঞ্জ এবং নবাবগঞ্জ নামে দুইটি দুইটি বাজার স্থাপন করেন।
৪ ।
গুপ্ত পাড়া : উনিশ শতকের শেষ দিকে আইন পেশার কারণে আদি নিবাস টাঙ্গাইল থেকে রংপুরে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন প্রখ্যাত আইনজীবী উমেশ চন্দ্র গুপ্ত। আইন পেশার পাশাপাশি রাজনীতি সচেতন সমাজ সংস্কারক ও একজন মজলিসী মানুষ হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন তিনি। বিংশ শতাব্দীর গোঁড়ার দিকে (১৯০০-১৯০২) রংপুর পৌরসভার চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তাঁর নামানুসারেই রংপুর শহরে তাঁর বসবাসের এলাকাটির নাম হয়েছে ‘গুপ্ত পাড়া’।
5 ।
নিসবেতগঞ্জ : রংপুরের প্রাচীন শিল্পগুলির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে শতরঞ্চি। রংপুর শহর সংলগ্ন ঘাঘট পাড়ের পীরপুর গ্রাম ছিল শতরঞ্চির জন্য বিখ্যাত। ১৮৩০ সালে রংপুর জেলার কালেক্টর ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক মিঃ জেএন নিসবেত। তিনি রংপুর শহর সংলগ্ন পীরপুর গ্রামে উৎপাদিত রং বেরঙের শতরঞ্চি দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। মিঃ নিসবেত নিজে পীরপুর গ্রামের শতরঞ্চি ব্যবহার করতেন। পরবর্তীতে তিনি এই শতরঞ্চি তৈরির গুনগত মান উন্নয়ন এবং এই শিল্পের সম্প্রসারণের জন্য ব্যাপক সহায়তা প্রদান করেন। এই শিল্পের বিপণন ব্যবস্থার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় তাঁর প্রতি সম্মান জানিয়ে শতরঞ্চি শিল্প সমৃদ্ধ গ্রাম পীরপুরের নামকরণ করা হয় তাঁর নামানুসারে নিসবেতগঞ্জ।
6 ।
রবার্টসনগঞ্জ : ১৯ শতকের শেষ ভাগে রংপুরে রেল লাইন স্থাপন করা করা হলে স্টেশন সংলগ্ন এলাকার ব্যবসায়িক গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। সেই সময়ে রংপুরের প্রধান কৃষিজাত পণ্য ছিল পাট এবং তামাক। ষ্টেশনকে কেন্দ্র করে আশেপাশে গড়ে ওঠে বেশ কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। পাটের গুদাম। সেই সময়ে ‘রবার্ট ওয়াটসন এন্ড কোম্পানি’ ছিল পাট এবং তামাকের বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। সেই রবার্ট ওয়াটসন এন্ড কোম্পানি থেকেই এলাকাটির নাম হয়ে যায় রবার্ট ওয়াটসনগঞ্জ। পরে তা হয়ে যায় রবার্টসনগঞ্জ।
7।
সদ্যপুস্করণী : শায়েস্তা খাঁর পুত্র ঘোড়াঘাটের ফৌজদার এবাদত খাঁ ১০৯৪ বঙ্গাব্দে (১৬৮৭ খ্রীঃ) রংপুর দখল করেন। কথিত আছে, সীমান্ত অতিক্রম যে স্থানে শিবির স্থাপন করেছিলেন, সেখানে পানির সমস্যা দেখা দেওয়ায় দ্রুতগতিতে এক রাতে একটা পুকুর খনন করেন তিনি। সদ্য অর্থাৎ অবিলম্বে পুকুরটি খনন করেন দেখে পুকুরটির সদ্যপুস্করণী নাম হয়। এবং পুকুরটিকে কেন্দ্র করে ওই এলাকার নাম এখনো সদ্যপুস্করণী। যা বর্তমান রংপুর শহর থেকে ১২/১৩ কিমি দূরে।
৮।
তাজহাট : তাজহাট জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা মান্না লাল রায় পাঞ্জাব থেকে রংপুরে এসে বসবাস শুরু করেন। প্রথমে তিনি নানা ধরণের নামী দামী হীরা, মানিক জহরতখচিত তাজ বা টুপির ব্যবসা করেছিলেন। উক্ত তাজ বিক্রির লক্ষ্যে এখানে হাট বসে যা পরবর্তীতে বিরাট প্রসিদ্ধি লাভ করে এবং এ অঞ্চলের নাম হয় তাজহাট। এ তাজহাটকে কেন্দ্র করে এই জমিদারবাড়ীর নামকরণ করা হয় তাজহাট জমিদার বাড়ি।।
৯ ।
কামাল কাছনা-বাহার কাছনা : হায়দার আলী চৌধুরী রচিত ‘পলাশী যুদ্ধোত্তর আযাদী সংগ্রামের পাদপীঠ’ থেকে জানা যায়, রংপুর অঞ্চলে মুঘল বংশীয়দের নিবাস ছিল শহর ১৩/১৪ কিমি পশ্চিমে মিঠাপুকুর উপজেলার ‘ফুলচৌকি’ গ্রামে। আর বর্তমান রংপুর শহরে ছিল ফুলচৌকি নগরের প্রতিষ্ঠাতা নবাব নূর উদ্দিন বাকের মোহাম্মদ জং ও তদ্বংশীয়দের আনন্দ প্রমোদের জন্য কয়েকটা ‘কাশানাহ’। কাশানাহ ফার্সি শব্দ। মূল অর্থে সেই কাঁচের ঘরকে কাশানাহ বলা হয় যা উজ্জ্বলকারী। ‘কাশ’ ও ‘আনাহ’ যোগ হয়ে এটি যৌগিক শব্দ। কাশ অর্থ কাঁচ এবং আনাহ সম্বন্ধ পদ। ‘কাশানাহ’ অর্থ প্রমোদ গৃহ যার পুরোটাই মনোরম ও আকর্ষণীয় কাঁচ দিয়ে মোড়ানো যা থেকে ঔজ্জ্বল্য ঝলমল করে কিন্তু বাতাস প্রবেশ করেনা। অর্থাৎ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। মূলত বিত্তশালীদের আমোদ প্রমোদের জন্য নির্মিত শীতকালীন প্রাসাদ বা বাসভবন। অবশ্য পাখীর নীড় অর্থেও ব্যবহৃত হয় শব্দটি। বর্তমান রংপুর শহরের যে এলাকায় নবাব ও শাহজাদাদের কাশানাহ ছিল তাঁদের নামানুসারে ঐ এলাকাগুলোর নামকরণ হয়েছে। যেমন – যেখানে শাহজাদা কামাল উদ্দিনের কাশানাহ ছিল সেই এলাকাটার নাম হয়েছে কামাল কাশানাহ। ‘কামালের কাশানাহ’ থেকে কামাল কাছনা। একই ভাবে ‘নওয়াবের কাশানাহ’ থেকে ‘নওয়া কাছনা’ এবং ‘বাকেরের কাশানাহ’ থেকে ‘বাহার কাছনা’ নাম এসেছে। (তথ্যসূত্র : পলাশী যুদ্ধোত্তর আযাদী সংগ্রামের পাদপীঠ : হায়দার আলী চৌধুরী)
১০ ।
লালবাগ : বিশ্বকোষ থেকে জানা যায় লালবাগ একটি হিন্দি ও পারসি শব্দ। বাগ শব্দের অর্থ বাগান। বর্তমান রংপুর শহরের আলমনগরের পাশ্ববর্তী একটি অংশে ছিল অজস্র ফুল গাছে ভরা এক বিশাল বাগান। যার নামকরণ করা হয়েছে নবাব নূর উদ্দিন বাকের মোহাম্মাদ জং বড় কন্যা লাল বিবির নামানুসারে লালবাগ। এই লাল বিবির কবর রয়েছে তামপাট এলাকায়। অথচ সেখানে একটা বাঘের ভাস্কর্য বানিয়ে নাম দেওয়া হয়েছে লালবাগের বাঘ। পরবর্তী প্রজন্ম ভাববে এখানে লালরঙের বাঘ পাওয়া যেতো তাই লালবাগ নাম।
তথ্যসূত্র : রংপুরের ইতিহাস সম্পর্কিত বিভিন্ন বই।
● অর্পিতা ঐশ্বর্য কামাল কাছনা রংপুর ।