শেখ হাসিনার সরকারের মেয়াদের শেষ বছর

শেখ হাসিনার সরকারের মেয়াদের শেষ বছর

মোনায়েম সরকার: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। ওই নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয় অর্জন করেছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। আওয়ামী লীগ জোট পেয়েছিল ২৬৬ আসন। বিএনপি জোট ৭, জাতীয় পার্টি ২২ এবং অন্যান্যরা পেয়েছিল ৪টি আসন। ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি শপথ গ্রহণ করেছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভা। মহাজোট জয়লাভ করবে, এটা প্রায় নিশ্চিত থাকলেও এত বিপুল সংখ্যক আসনে জয়লাভ এবং বিএনপি এত কম আসন পাওয়া ছিল অভাবিত।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেও নির্বাচন শতভাগ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়নি। বিএনপি ও তার মিত্ররা নির্বাচনের ফলাফল বর্জন করলে নতুন নির্বাচন দাবি করে সে দাবি আদায় করতে পারেনি। সংসদ বাতিলের দাবি জানিয়েও বিজয়ীরা নানা নাটকীয়তা শেষে শপথ নিয়ে সংসদে যোগও দিয়েছে।  দেশের মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে প্রবল ক্ষোভ ছিল না বলেই হয়তো ওই সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত সরকার মেয়াদকাল শেষ করতে চলেছে। চার বছর পূর্ণ হলো। শেষ বছরটিও পার না করার কোনো বাস্তব কারণ বা লক্ষণ কিছুই এখনো দেখা যাচ্ছে না।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত চতুর্থ মন্ত্রিসভায় ১৪ দলের কাউকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এটাও অনেকের কাছে প্রত্যাশিত ছিল না। বিশেষ করে ১৪ দলের শরিকেরা নিশ্চয়ই হতাশ হয়েছে। তবে এনিয়ে বড় ক্ষোভ বা অসন্তোষের কথাও সেভাবে শোনা যায়নি। শেখ হাসিনা যেটা ভালো মনে করেছেন, সেটাই করেছেন এবং অন্যরা তা মেনে নিয়েছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট মাত্র ৭টি আসন পাওয়ায় সংসদে বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সিট সমঝোতা করে নির্বাচনে ২২ আসনে জয়লাভ করলেও সরকারে না নিয়ে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে দেশ শাসনের সুযোগ পায়। এটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক অনন্য ঘটনা। এর আগে এত দীর্ঘ সময় সরকারে থাকার সুযোগ আর কেউ পাননি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধিও হয়েছে অভূতপূর্ব। ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে দেশের মানুষ কিছু পায়’ বলে শেখ হাসিনা প্রায়ই যে কথা বলে থাকেন, সেটা একেবারেই কথার কথা নয়। শেখ হাসিনা প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছিলেন ১৯৯৬ সালে। প্রথমবার এবং দ্বিতীয় বার ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় থেকে শুরু করে সামাজিক সূচকের প্রায় সবগুলোতেই ভালো অবস্থানে পৌঁছেছে। গড় আয় এখন ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার। গড় আয়ু প্রায় ৭৩ বছর। শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হারও অনেক কমেছে।

কৃষি উৎপাদনেও বাংলাদেশের উন্নতি চোখে পড়ার মতো। আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ৯৪তম কিন্তু চাল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে তৃতীয়। মাছ উৎপাদনে তৃতীয়, আলু উৎপাদনে সপ্তম, ডিম ও মাংস উৎপাদনে ২৯তম, ফল উৎপাদনে ৩৭তম। সরকারের নীতি ও পরিকল্পনার কারণেই বাংলাদেশের এই সমৃদ্ধি যাত্রা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ ঘন বসতির দেশ। আয়তনের তুলনায় মানুষ অনেক বেশি। কৃষি জমির পরিমাণ কমে আসা সত্ত্বেও উৎপাদন যে কমছে, এরজন্য অবশ্যই সাধারণ মানুষের শ্রম দেওয়ার মনোভাবই বড় কারণ। কিন্তু একই সঙ্গে বীজ, সারসহ কৃষি উপকরণে সরকারের ভর্তুকি দেওয়া ও সময়মতো সরবরাহ নিশ্চিত করার নীতিও গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বাংলাদেশকে উন্নয়নের মডেল হিসেবে জাতিসংঘ মহাসচিবও উল্লেখ করেছেন।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদা অর্জন করেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় বাংলাদেশের অগ্রগতিও বিস্ময়কর। গত বছর ২৫ জুন জনগণের চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। পৃথিবীর নদীসমূহের মধ্যে পদ্মাই হলো বেশি খরস্রোতা। এই নদীতে সেতু নির্মাণ খুব সহজ ছিল না। তারপরও পদ্মায় সেতু হয়েছে এবং সেটাও নিজস্ব অর্থায়নে। পদ্মা সেতু নির্মাণ যাতে সম্ভব না হয়, তার জন্য দেশের ভেতরে ও বাইরে কম ষড়যন্ত্র হয়নি। বিশ্বব্যাংক থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো অর্থায়ন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু বানানোর ঘোষণা দিলে অনেকেই এটা অসম্ভব বলে উল্লেখ করলেও, সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছেন শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতু এখন বাংলাদেশের সক্ষমতা ও গৌরবের প্রতীক।

পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনে শুধু নতুন দিন আসেনি, এর ফলে দেশের অর্থনীতিতেও গতিবেগ সঞ্চার হবে। শুধু পদ্মা সেতু নয়, শেখ হাসিনার আমলে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয়েছে। গত নভেম্বর মাসেই উদ্বোধন হয়েছে ছোটবড় ১০০ সেতু। ২৮ ডিসেম্বর উদ্বোধন হয়েছে মেট্রোরেল। রাজধানীর যানজট নিরসনে মেট্রোরেল বড় ভূমিকা রাখবে। অল্প সময়ের মধ্যেই চালু হবে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। এসব বড় বড় প্রকল্পে দুর্নীতি, সময়মতো করতে না পারাসহ কিছু সমালোচনা নেই তা নয়। এগুলো এড়াতে পারলে নিশ্চয়ই বেশি ভালো হতো। কিন্তু ওই সব সমালোচনা সত্ত্বেও এটা বলতেই হবে যে এগুলো না হলে আমরা অহংকার করে নিজেদের বড় বলতে পারতাম না। শেখ হাসিনার সাহস ও দূরদর্শিতার কারণেই বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে পেরেছে এবং আরও কিছু বাস্তবায়নের পথে আছে। বড় কিছু করতে গেলে বড় মন থাকতে হয়, থাকতে হয় দেশপ্রেম ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা। শেখ হাসিনা এই সব বিরল গুণের অধিকারী বলেই তাঁকে বিকল্পহীন নেতা ভাবা হচ্ছে। এটা নিয়ে ইচ্ছে করলে কেউ বিতর্ক করতে পারেন, তবে আমি মনে করি, শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপির আন্দোলন সফল না হওয়ার একটি বড় কারণ শেখ হাসিনার প্রতি জনগণের আস্থা এবং বিরোধীদের প্রতি অনাস্থা ও অবিশ্বাস।

অবশ্য সেজন্য শেখ হাসিনার সামনে কোনো চ্যালেঞ্জ নেই, সেটাও আমি মনে করি না। নতুন বছরটি শেখ হাসিনা, তার সরকার এবং দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সামনে কতগুলো বড় চ্যালেঞ্জ আছে। এই চ্যালেঞ্জগুলো সফলতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে না পারলে আগামী বছরের শুরুতে দেশে যে জাতীয় নির্বাচন হবে, তাতে বিজয় অর্জন সহজ হবে না।

শেখ হাসিনার সামনের চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে আমি এখানে সামান্য আলোকপাত করতে চাই। পরবর্তী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগই বিজয়ী হোক এবং দেশের সমৃদ্ধি যাত্রা অব্যাহত থাকÑ এটা দেশের মানুষের প্রত্যাশা। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, নানা কারণে আগামী নির্বাচনটা হবে গুরুত্বপূর্ণ। আগের দুটি নির্বাচন নিয়ে যেহেতু সমালোচনা ও বিতর্ক আছে, সেহেতু আগামী নির্বাচনে বিদেশিদের যেমন নজর থাকবে, তেমনি নজর থাকবে দেশের মানুষেরও। বিএনপির পছন্দের সরকারের অধীনে যদি নির্বাচনই না-ও হয়, তবুও আগের মতো সহজ জয়ের নির্বাচন পরেরটা হবে না।

শেখ হাসিনার প্রতি যেমন মানুষের আস্থা বেড়েছে, তেমনি আওয়ামী লীগের প্রতিও মানুষের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। শেখ হাসিনা-ম্যাজিকে সব বিপদ থেকে রেহাই পাওয়ার যে মানসিকতা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী-সমর্থকদের মধ্যে গড়ে উঠেছে, তা ক্ষতিকর। আগামী নির্বাচন যে সহজ হবে না, তার একটি ছোট উদাহরণ রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দেখা গেছে। রংপুর সিটিতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী চতুর্থ স্থানে আছেন। আওয়ামী লীগের একজন বিদ্রোহী পার্থীও নৌকা মার্কার চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছন। এই শোচনীয় পরাজয় প্রত্যাশিত ছিল না। এর কারণ অনুসন্ধানে মনোযোগী হতে হবে।

সরকার পরিচালনায় শেখ হাসিনা যতটা সফল, দল গোছানোর ক্ষেত্রে ততটা এগিয়ে আছেন বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগ দলগতভাবে এখন কিছুটা অসহায় অবস্থায় আছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। দলের জাতীয় সম্মেলনে যে নতুন কমিটি হয়েছে সেখানে কোনো উল্লেখ করার মতো পরিবর্তন নেই। বলা হচ্ছে, পুরোনোদের ওপরই শেখ হাসিনা আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য আস্থা রেখেছেন। এখন এই পুরোনো টিম শেখ হাসিনার আস্থা কী প্রতিদান দেবে তা-ই এখন দেখার বিষয়। তবে আগামী নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের সময় খুবই সতর্ক থাকতে হবে। একাধিক বার নির্বাচিত কিংবা প্রথম বার নির্বাচিত হওয়ার পরও যাদের জনগণের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে কিংবা যাদের বিরুদ্ধে দ্র্নুীতিস্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের ব্যাপক অভিযোগ আছে, তাদের বাদ দিয়ে ক্লিন ইমেজের প্রার্থী বেছে নিতে হবে। বর্তমান মন্ত্রিসভার মেয়াদের শেষ বছর উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পাশাপাশি দলের মধ্যেও কিছু শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে হবে।

আগামী নির্বাচনের আগে দেশের মানুষের মনে অসন্তোষ তৈরি হয় এমন কিছু করা থেকে সরকারকে বিরত থাকতে হবে। জিনিসপত্রের দাম যদি ক্রমাগত বাড়তে থাকে, মানুষ যদি সারাক্ষণ অসহায় বোধ করতে থাকে তাহলে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভও বাড়বে। আর বিরোধী দল যেন সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের কোনো সুযোগ না পায়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।

গণতান্ত্রিক পরিবেশ সংকুচিত হয়েছে বলে বিএনপির প্রচারণার যুৎসই জবাবও সরকার পক্ষ থেকে দিতে হবে। বিএনপি যে একটি গণতান্ত্রিক দল নয়, তা তাদের শাসনামলের বিভিন্ন ঘটনা থেকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা কঠিন কিছু নয়। ২০০১ সালে এবং ২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াত যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, তা কি ভুলে যাওয়ার মতো?

বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন জমাতে চাইছে। মিত্র বাড়াতে সচেষ্ট আছে। কিছু পশ্চিমা দেশের কূটনীতিক তাদের ছাতা দিচ্ছে। এসব বিষয় ছোট আছে, তবে ছোট বিষয়গুলো যেন বড় হয়ে দেখা না দেয়। সরকারের মেয়াদ পূর্ণ করা কোনো অসম্ভব কাজ হবে না। তবে আরেক দফা ক্ষমতায় ফিরে আসা চ্যালেঞ্জিং বলেই মনে হচ্ছে।

০৭ জানুয়ারি, ২০২৩

মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.