বাংলাদেশের রাজনীতি পিছন ফিরে দেখা

বাংলাদেশের রাজনীতি পিছন ফিরে দেখা

মোনায়েম সরকার: বাংলাদেশের রাজনীতি ক্রমে ক্রমেই জটিলতর হচ্ছে। বিশ্বের সবদেশেই রাজনীতি এখন সংকটাপন্ন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি পৃথিবীকে আরো সংকটের মধ্যে ফেলেছে। অনেক দেশেই ইতোমধ্যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে গেছে। গরিব দেশগুলোতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমনিতেই নাজুক থাকে। বিশ্বের রাজনৈতিক পটভূমি পরিবর্তিত হলে সেই অভিঘাত সব দেশেই কম বেশি পরিলক্ষিত হয়। আজকাল অনেকেই বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্র নেই, পরমতসহিষ্ণুতা নেই, নেই মুক্তভাবে রাজনীতি চর্চা করার পরিবেশ। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে স্বাধীনতা-পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশে কখন, কবে সুস্থভাবে রাজনীতি করার সুযোগ ছিল? ইতিহাসকে ইতিহাসের নিরিখে বিচার না করে যারা আবেগ দিয়ে ইতিহাস বিচার করতে চান তারাই বেশি বেশি প্রলাপ বকেন বাংলাদেশের ভঙ্গুর রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে।

আমরা যদি একটু পিছন ফিরে তাকাই, তাহলে দেখব বাংলাদেশ এখন যে সুবর্ণ সময় পার করছে এই সময়টাতেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে সুন্দর আবহাওয়া বিরাজ করছে। গণতন্ত্র চর্চা, বাক-স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশের অবাধ সুযোগ, নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য উদার আহ্বানকে যদি আমরা রাজনীতির স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বলে আখ্যায়িত না করি, তাহলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিকে ‘শোষিতের গণতন্ত্রে’ রূপ দিতে চেয়েছিলেন। ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ ছিল বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব রাজনৈতিক মতবাদ। এটি মূলত গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের অনন্য সমন্বয়। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমাজতান্ত্রিক জীবনধারা প্রবর্তন করাই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের মূল কথা ছিল। বঙ্গবন্ধুর শোষিতের গণতন্ত্র বাস্তবায়িত হলে শুধু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটতো না, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতো। কিন্তু ঘাতকের দল বঙ্গবন্ধুকে সেই সুযোগ দেয়নি। বঙ্গবন্ধু যেন কিছুতেই স্বাধীন বাংলার মাটিতে সুস্থ ধারার রাজনীতি প্রবর্তন করে দেশকে সুন্দর মতো পরিচালনা করতে না পারেন, সেই জন্যে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র অব্যাহত ছিল। সেসব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করা বঙ্গবন্ধুর জন্য সম্ভব না হলেও তার সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ঠিকই সব ষড়যন্ত্র কঠিনভাবে মোকাবিলা করে দুর্বার গতিতে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে বাংলার মীর জাফর খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেও তার নেপথ্যে ছিল মেজর জিয়াউর রহমানের নীল নকশা। জিয়া মোশতাককে কৌশলে হটিয়ে নিজেই বাংলাদেশের ক্ষমতা গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ-বিরোধী ঘাতকচক্রকে রাজনীতি করার সুযোগ দেন। আওয়ামী লীগের উপর শুরু করেন চরম নির্যাতন-নিপীড়ন। জিয়ার মদদেই ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণ্য নাটক মঞ্চস্থ হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। সেখানে বন্দি অবস্থায় হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শূন্যতা সৃষ্টি করার জন্যই জিয়া কৌশলে এই কাজটি করেন। জিয়া শুধু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপরই দমন-নিপীড়ন চালাননি, তিনি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করার জন্য কালো আইন তৈরি করেন। বিভিন্ন দূতাবাসে খুনিদের পদায়ন করে ইতিহাস কলঙ্কিত করেন। তিনি ‘হ্যাঁ’/‘না’ ভোটের মাধ্যমে নিজের ক্ষমতা সুদৃঢ় করেছিলেন। রাতের বেলা কারফিউ দিয়ে দেশ চালাতেন।

চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে নিজের অনুগত সেনা অফিসারদের হাতে নির্মমভাবে খুন হন জিয়া। জিয়ার মৃত্যুর পরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন জেনারেল এইচ এম এরশাদ। তিনিও জারি করেন সামরিক আইন। শুরু করেন হত্যার রাজনীতি। নিজের অপকীর্তির জন্য বাংলার ইতিহাসে এরশাদ ‘স্বৈরাচার’ হিসেবে খ্যাত হন। দীর্ঘ দশ বছর এরশাদ সামরিক আইন জারি রেখে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ অবরুদ্ধ করে রাখেন। আপামর জনতার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে এরশাদের পতন হলে, রাজাকার-আলবদরদের নিয়ে নির্বাচনী জোট গঠন করে ক্ষমতায় আসেন জিয়াপতœী বেগম খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়া এসে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপর আরও বেশি চড়াও হন। তার শাসনামলে অসংখ্য নেতাকর্মী খুন হন। জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্যও ছক কষেন খালেদা জিয়া, তার পুত্র তারেক জিয়া ও দলের অন্যান্য শরিকেরা। খালেদা জিয়া শুধু হত্যা করেই আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা করেননি, তিনি বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকে তিনি প্রহসনমূলক নির্বাচন দেন ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য এই ষড়যন্ত্রমূলক নির্বাচনে ব্যাপক সংখ্যারিগষ্ঠতা অর্জন করে বিএনপি। মাগুরা উপনির্বাচনে তারা যে তা-ব চালায় সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা এদেশের মানুষ বিস্মৃত হননি। বাংলাদেশের নির্বাচন এবং রাজনীতিকে হত্যার জন্য বিএনপি তার দায়ভার কিছুতেই এড়াতে পারে না।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান উচ্চাভিলাসী ছিলেন। তিনি কালো চশমায় চোখ ঢেকে রাখলেও তার চারিত্রিক ত্রুটি ঢেকে রাখতে পারেননি। যেই তাহের জিয়াকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন তাক্ইে তিনি নির্মমভাবে হত্যা করেন ফাঁসিতে ঝুলিয়ে। হত্যার রাজনীতি বাংলাদেশে প্রথম বিএনপিই শুরু করেছিল। তারা গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে রাষ্ট্রীয় শাসনভার গ্রহণ করে। আজ আমরা গণতন্ত্রের পক্ষে বিএনপির নেতাদের কাছ থেকে অনেক কথাই শুনি। তাদের কাছে জানতে চাই ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন কি গণতান্ত্রিক ছিল? ২০০১ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে পাঁচ বছর পর যথাযথ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন না করে কারা আর্মি সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে রাতের অন্ধকারে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল? কেন একটি অসাংবিধানিক সরকার প্রায় তিন বছর স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষমতায় ছিল?

খুবই আশ্চর্য হই যখন এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হই। আমিও এক সময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম। খালেদা জিয়ার সঙ্গে দুই-একবার মিটিং করার সুযোগ আমারও হয়েছে। ১৯৯১ সালে কেয়ার টেকার সরকারের রূপরেখা নিয়ে দুই নেত্রীর সাক্ষরিত চিঠি ‘দেশ’ পত্রিকায় ছাপা হয়। তখন তাদের সঙ্গে আমার ছবিও ওই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত কোনো বিষয় নিয়ে কথা না বলে আমি শুধু বলতে চাই, বিএনপি বার বারই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশকে নির্বাসিত করার ষড়যন্ত্র করেছে সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে। বাংলাদেশে সীমাহীন দুর্নীতি করে সেই দুর্নীতির টাকা দিয়েই তারা কলুষিত করেছে বাংলাদেশের রাজনীতি। তারেক, কোকো, মামুন, বাবর গংদের দুর্নীতির মাধ্যমে বার বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। দুর্নীতির অপরাধে এরা সবাই এখন অপরাধী ও আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত। তাদের তৈরি করা ফাঁদে পড়ে তারাই আজ হাঁসফাঁস করছে পরিত্রাণের জন্য। কিন্তু এ কথা তারা ভুলেই গেছেন অতীত অপকর্মের জন্য তাদের মুখে গণতন্ত্রের কথা মোটেই শোভা পায় না।

খুন, গুম, হত্যার রাজনীতি বিএনপিই প্রথম শুরু করে। জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদ উভয়েই অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। উভয়েই নানাপ্রকার চক্রান্ত করে আওয়ামী লীগকে তথা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ও গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে চেয়েছেন। আজ এদের পক্ষে কথা বলা মানে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কথা বলা, গণতন্ত্রের বিপক্ষেই কথা বলা। দেশে অনেক রাজনৈতিক জঞ্জাল জমেছে। সেই জঞ্জাল পরিষ্কার করতে হলে, দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে আওয়ামী লীগকে সময় ও সমর্থন দেওয়া দরকার।  

দেশে এখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক সাফল্যের মধ্যে কিছু বড় সাফল্য হলো বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম, পদ্মা সেতু নির্মাণ ও অসংখ্য মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন। আওয়ামী লীগ নির্ধারিত সময়ে ক্ষমতা শেষ করে সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য বিএনপি নেত্রীকে টেলিফোনে আহ্বান জানালে বিএনপি সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। দেশকে সাংবিধানিক সঙ্কট থেকে মুক্ত করতে অন্যান্য দল নিয়ে নির্বাচন করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে বাংলাদেশের প্রভুত উন্নয়ন করেছে। এই বিষয়টিকে অনেকেই আজ বাঁকা চোখে দেখার চেষ্টা করেন। কিন্তু তারা কি হিসেব করে দেখেছেন বাংলাদেশ আজ উন্নতির কোন শিখরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দেশ এগিয়ে যায়, ইতিহাস তার গতি ফিরে পায়; কারণ আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস করে, স্বনির্ভর বাংলাদেশে বিশ্বাস করে। বাংলাদেশের সকল উন্নয়নের সূচক দেখে এ কথা আজ নিঃসন্দেহে বলা যায় দেশ গণতন্ত্রের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। এখন যারা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলে তারা মূলত গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে স্বৈরতন্ত্র বা মৌলবাদতন্ত্রের পক্ষেই ওকালতি করে। বাংলার মানুষ মুখোশধারী দেশদ্রোহীদের কথায় ভুলে বর্তমান গণতান্ত্রিক ধারা থেকে বিচ্যুত হলে দেশ আবার কসাইখানায় পরিণত হবে। সৃষ্টি হবে, বাংলা ভাই, মুফতি হান্নানের মতো ভয়ঙ্কর দৈত্য। দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি না করে দেশপ্রেমিক জনগণ উন্নয়নে স্বতস্ফূর্ত অবদান রাখবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

-মোনায়েম সরকার : রাজনীতিবিদ, লেখক, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, গীতিকার ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.