মোনায়েম সরকার: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। ভাষা-আন্দোলন থেকে শুরু করে দীর্ঘদিনের লড়াই-সংগ্রাম-জেল-জুলুম সহ্য করে ধীরে ধীরে তিনি পূর্ব বাংলার জনগণকে সংঘটিত করে চূড়ান্ত বিজয়ে উপনীত হন। বাংলার সাড়ে সাত কোটি বাঙালি বঙ্গবন্ধুর আপসহীন নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন করে বিশ্বের বুকে অনন্য নজির স্থাপন করেন।
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধু কলকাতা থেকে ঢাকা শহরে এসে রাজনীতি শুরু করেন। পূর্ব বাংলার সূর্যসন্তান শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন পাকিস্তানের কাছে এমন একটি সমাজ কাঠামো প্রত্যাশা করেছিলেন যেখানে কোনো শোষণ-বঞ্চনা থাকবে না, একজন মানুষ কোনো কারণে আরেকজন মানুষকে জুলুম-নিপীড়ন করবে না, কিন্তু সদ্যস্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পরেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগণ পূর্ব বাংলার (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) জনগণের ওপর দমন-পীড়ন শুরু করেন। আহমদ রফিক যথার্থই বলেছেনÑ
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনই ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম সরব প্রকাশ। পুরনো সম্প্রদায়ভিত্তিক অনুভব থেকে এর উদ্ভব হলেও, এই অনুভবের মধ্যদিয়ে ক্রমে ক্রমে বাঙালি মুসলমানদের অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদে উত্তরণ সম্ভব হয়েছে।১
১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের শাসকগণ ‘রাষ্ট্রভাষা’ বিতর্ক উস্কে দিয়ে বাংলা ভাষাকে বাংলার মানুষের মুখ থেকে কেড়ে নেওয়ার অপচেষ্টা করে। ১৯৪৮ সালেই বাংলা ভাষাকে মর্যাদাসীন করার জন্য গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তানি শাসকচক্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমির এক সভায় বঙ্গবন্ধু বলেনÑ
‘১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা প্রস্তাব করলে কোনো মুসলমান গণপরিষদ সদস্য তার প্রতিবাদ জানাননি। এর প্রতিবাদ করেছিলেন একজন হিন্দু, তিনি কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। এর সাথে ছিল ছাত্রদের প্রতিবাদ।’২
১৯৪৮ সালে যখন বাংলাকে হটিয়ে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করা হয় শেখ মুজিব তখন আটাশ বছরের টগবগে যুবক। সদ্য কলকাতা থেকে ঢাকায় আসা শেখ মুজিব সাংগঠনিকভাবে কিছুটা দুর্বল হলেও ধীরে ধীরে তিনি প্রতিবাদের শক্তি সঞ্চয় করেন। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ (বর্তমানে আওয়ামী লীগ) গঠিত হওয়ার ফলে সাংগঠনিকভাবে বাঙালি তাদের ন্যায্য দাবিদাওয়া আদায় করার প্ল্যাটফর্ম খুঁজে পায়। ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের ভাগ্যবিধাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব পুনর্ব্যক্ত করলে বাংলার আপামর জনতা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। কার্জন হলে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বক্তৃতা ছাত্ররা প্রত্যাখ্যান করলে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। শুরু হয় রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। ১৯৫২ সালেও শেখ মুজিব ভাষা-আন্দোলন প্রশ্নে কারারুদ্ধ হন। তখন বন্দি অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকেই তিনি গোপনে ভাষা সংগ্রামীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেনÑ
বারান্দায় বসে আলাপ হল এবং আমি বললাম, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী লীগ নেতাদেরও খবর দিয়েছি। ছাত্রলীগই তখন ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। ছাত্রলীগ নেতারা রাজি হল। অলি আহাদ ও তোয়াহা বলল, যুগলীগও রাজি হবে। আবার ষড়যন্ত্র চলছে বাংলা ভাষার দাবিকে নসাৎ করার। এখন প্রতিবাদ না করলে কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিম লীগ উর্দুর পক্ষে প্রস্তাব পাস করে নেবে। নাজিমুদ্দীন সাহেব উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথাই বলেন নাই, অনেক নতুন নতুন যুক্তিতর্ক দেখিয়েছেন। অলি আহাদ যদিও আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সদস্য হয় নাই, তবুও আমাকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই শ্রদ্ধা করত ও ভালবাসত। আরও বললাম, ‘খবর পেয়েছি, আমাকে শীঘ্রই আবার জেলে পাঠিয়ে দিবে, কারণ আমি নাকি হাসপাতালে বসে রাজনীতি করছি। তোমরা আগামীকাল রাতেও আবার এস।’ আরও দু’একজন ছাত্রলীগ নেতাকে আসতে বললাম। শওকত মিয়া ও কয়েকজন আওয়ামী লীগ কর্মীকেও দেখা করতে বললাম। পরের দিনরাতে এক এক করে অনেকেই আসল। সেখানেই ঠিক হল আগামী ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত সৃষ্টি করা শুরু হবে।৩
সেই সংগ্রামে সম্মুখসারিতে থেকে যারা নেতৃত্ব দেন, কারাবরণ করেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তাঁদের অন্যতম। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম কারো একক কৃতিত্বের বিষয় না হলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন যে ভূমিকা পালন করেন, বাংলাদেশের মানুষ তা কোনোদিন বিস্মৃত হবে না। জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী তাঁর ‘মুজিব-মানস ও ভাষা-আন্দোলন’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেনÑ
১৯৪৮-এর ফেব্রুয়ারিতে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা সম্পর্কিত লিয়াকত আলি খানের উক্তির মধ্য দিয়ে তার উদ্ধত নগ্ন প্রকাশ ঘটল। বাঙালি অবশ্য চুপ করে বসে থাকল না। তারা দাবি করল যে বাংলাকেও উর্দুর সাথে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে হবে। যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা এবং হাজার বছরের ঐতিহ্যম-িত একটি সমৃদ্ধ ভাষা হিসেবে তারা সেদিন বাংলাকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তুলতো তবে তাও অযৌক্তিক হতো না। যাই হোক, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৪৮-এর ১১ মার্চ দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়া হলো। পাকিস্তানী শাসকচক্র ওই ধর্মঘট ব্যর্থ করার জন্য সেদিন ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করলো। ঢাকার ছাত্ররা শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে মিছিল বের করে। পুলিশ মিছিলকারীদের উপর বেপরোয়া লাঠি চালায়। বহু ছাত্র-জনতা আহত হয়। আন্দোলনকারী কতিপয় অগ্রণী ছাত্র-যুবকদের সাথে শেখ মুজিবকেও সেদিন গ্রেফতার করা হয়েছিল।৪
একুশের চেতনাকে বাস্তবায়ন করতে রাজনৈতিক নেতা, ছাত্র-শিক্ষক-শ্রমিকসহ সকলেই সীমাহীন নির্যাতন সহ্য করেছেন। বেশ কয়েকজন ভাষা-সৈনিক ১৯৫২ সালের একুশের ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে নির্মমভাবে নিহত হন। অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম (সদ্যপ্রয়াত) সেদিনের ঘটনাবলি তার ক্যামেরাবন্দি করে স্মরণীয় করে রেখেছেন। একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা কোনো সামান্য ঘটনা নয়, এই ঘটনার মধ্যেই নিহিত ছিল বাঙালি জাতির মুক্তি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ। অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলামের ক্যামেরা ও কলম দুটোই সেদিন জ্বলে উঠেছিল। ড. রফিকুল ইসলাম প্রায় শ’খানেক দুর্লভ ছবি তোলেন। সেসব ছবির ৫০টির মতো আমার সংগ্রহেই আছে।
ভাষা সৈনিক হিসেবে প্রত্যেকেই আমাদের কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র। কিন্তু অসংখ্য ভাষা সংগ্রামীর মধ্যে কেউ কেউ আছেন, সত্যিকার অর্থেই যাদের ত্যাগ ছিল অসামান্য। একুশের প্রথম কবিতা রচনা করেন চট্টগ্রামের কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী। তাঁর ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতাটি একুশে ফেব্রুয়ারির বীর শহিদদের স্মরণে লেখা হয়েছিল। এই কবিতা সেদিন সারা বাংলার মানুষের মনে একই সঙ্গে শোক ও সংগ্রামের প্রেরণা জাগিয়েছিল।
১৯৫২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি যখন পুলিশ বাহিনী ছাত্র-জনতার নির্মিত শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দেয়, তখন তা দেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আলাউদ্দিন আল আজাদ তাঁর বিখ্যাত ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ কবিতাটি রচনা করেন (যার কয়েকটি লাইন এরকমÑ স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কী বন্ধু / আমরা এখনো চারকোটি পরিবার/খাড়া রয়েছি তো/)।
একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে এ পর্যন্ত যত কবিতা-গান রচিত হয়েছে সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কবিতা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী একজন ভাষা-সংগ্রামী। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন মুহূর্তে তিনি ঢাকা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে তিনি ভাষা-সৈনিকদের মিছিলে যোগদান করে কিছুটা আহত হন। এমন সময় আহমেদ হোসেন নামে একজন ভাষা সৈনিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর দিকে এক টুকরো সাদা কাগজ দিয়ে বার বার অনুরোধ করতে থাকেনÑ ‘তোমরা একটি কবিতা লেখো।’ ওই মুহূর্তে তখন কবিতা লেখা সম্ভব না হলেও কথাটি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী মনে গেঁথে থাকে। রক্তাক্ত শহিদ রফিকের চেহারার কথা মনে করে ঐতিহাসিক কবিতাটির প্রথম কয়েকটি লাইন তিনি রচনা করেন প্রিন্সিপাল সাইদুর রহমানের বাসায় বসে। বাকি অংশ লেখেন অন্য একটি বাসায়। এই কবিতাটিতে সুরারোপ করে গান হিসেবে প্রথম ব্যবহার করা হয় ঢাকা কলেজের একটি অনুষ্ঠানে। গানটি পরিবেশন করেন অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলামের ছোট ভাই আতিকুল ইসলাম। তিনি এবং তার কয়েকজন বন্ধু এই গানটি পরিবেশন করার পর ঢাকা কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন। উল্লেখ্য, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কবিতাটিতে বিভিন্নজন সুরারোপ করলেও আজ সারা বিশ্বে শহিদ আলতাফ মাহমুদের সুরেই গানটি গীত হচ্ছে। এই গানটি একই সঙ্গে সুর¯্রষ্টা আলতাফ মাহমুদ ও আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে অমরত্ব দান করেছে।
আজ ড. রফিকুল ইসলাম আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তার ঐতিহাসিক কাজগুলো আমাদের মাঝে রয়েছে। তাঁর ভাষা-আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ নিয়ে যেসব গবেষণা ও সৃজনশীলকর্ম রয়েছে তা চিরদিন বাঙালিকে প্রেরণা জোগাবে। আমাদের আরেক ভাষা সংগ্রামী আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীও অসুস্থ হয়ে লন্ডনে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯ মে, ২০২২ তারিখে ৮৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলা ভাষার সংগ্রামের ফসল আজ ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে’র মর্যাদা লাভ করেছে। পাকিস্তানিরা ভেবেছিল বাঙালি জাতির মুখের ভাষা কেড়ে নিলেই তাদের মেরুদ- ভেঙে ফেলা সম্ভব হবে, কিন্তু তারা এটা বুঝতে পারেনি যেই বাংলা ভাষাকে কৌশলে হত্যা করার জন্য তারা উর্দু ভাষাকে লেলিয়ে দিয়েছিল, সেই উর্দু ভাষা দিয়ে কিছুতেই বাঙালিকে পরাস্ত করা যাবে না। উর্দু পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ কোনো জনগণের ভাষা ছিল না। ওই ভাষায় পশ্চিম পাকিস্তানেই নগণ্য সংখ্যক মানুষ কথাবার্তা বলতো, অথচ বাংলা ভাষা ব্যবহার করতেন প্রায় ৫৬ শতাংশ মানুষ। ৫৬ শতাংশ মানুষের ভাষাকে অগ্রাহ্য করে মাত্র ৪ শতাংশ মানুষের মুখের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র পৃথিবীর কোথাও বাস্তবায়িত হতে পারে না। বাংলার মাটিতেও উর্দুর শিকড় প্রোথিত হতে পারেনি।
বাংলাদেশে যখন ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে, তখন আমিও আমার বড় ভাইদের সঙ্গে কুমিল্লায় মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করি। বয়সে আমি তখন ছোট হলেও ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ / ‘নুরুল আমীনের কল্লা চাই’ বলে সেদিন যেসব স্লোগান দিয়েছিলাম তা আমার আজো মনে পড়ে। যেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের কথা বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে উল্লেখ করেছেন, সেই মহান মানুষটির সঙ্গে আমারও কিছুটা সখ্য ছিল। আমি আমার শৈশবে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের অসামান্য ¯েœহ-ভালোবাসা পেয়েছি। তাঁর কাছ থেকে আমি অনেক কিছু পেয়েছি, তবে সেসব কিছু আজ মনে না থাকলে তার এধহফযর’ং ষবঃঃবৎং ঃড় ঞধমড়ৎব বইটি উপহারের কথা আমি কোনোদিন ভুলব না। তিনি আমাকে মর্নিং ওয়াকে নিয়ে যেতেন। মর্নিং ওয়াকের ফাঁকে ফাঁকে অনেক গল্প শুনিয়েছেন এবং বইপড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছেন। তার মতো দেশপ্রেমিকের সাহচার্য আমি দীর্ঘদিন পেয়েছি, এটা আমার পরম সৌভাগ্য।
আমি নিজেকে এই কারণে ভাগ্যবান মনে করি যে, বাংলাদেশের অধিকাংশ ভাষা-সৈনিকের সঙ্গেই আমি ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করার সুযোগ পেয়েছি। আমি বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদের ¯েœহ পেয়েছি। আবদুল মতিন, গাজীউল হকের সাহচার্য পেয়েছি। সাহচার্য ও বন্ধুত্ব পেয়েছি ড. রফিকুল ইসলাম ও আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর। কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী, এমনকি কবি আলাউদ্দিন আল আজাদও আমার ভীষণ প্রিয় মানুষ। তাদের ব্যক্তিত্ব ও লেখার স্টাইল এখনো আমাকে প্রাণিত করে।
একুশে ফেব্রুয়ারি আজ ইউনেস্কো ঘোষিত ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে’র মর্যাদা পেয়ে আমাদের গৌরব শিখাকে উজ্জ্বল করেছে বটে, কিন্তু এখনো বাংলাদেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলন হয়নি দেখে খুব বেদনাবোধ করি। বঙ্গবন্ধু সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের সর্বত্র বাংলা ভাষা প্রচলনের জন্য কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ভাষা বিজ্ঞানী না হয়েও বাংলা ভাষার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সেভাবেই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর আকস্মিক হত্যাকা-ের পর বাংলাদেশ সবক্ষেত্রেই পিছিয়ে পড়ে। বাংলা ভাষাও বাংলাবিদ্বেষীদের কবলে পড়ে অবহেলিত হয়। আজ আমরা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করে একান্ন বছরে পদার্পণ করেছি।
স্বাধীনতার অর্ধ-শতাব্দী পরেও বাংলা ভাষার গতিপথ সরল-স্বাভাবিক হয়নি, এটা খুবই দুঃখজনক। বাংলা ভাষার মর্যাদা আজ পৃথিবীব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা-ভাষী কবি হিসেবে নোবেল পুরস্কার লাভ করে বাংলা ভাষার গৌরব বৃদ্ধি করেছেন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চীনের শান্তি সম্মেলনে (১৯৫৬), জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে (১৯৭৩) এবং জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে (১৯৭৪) বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে বিশ্ববাসীর নজর কাড়েন। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলেই (১৯৯৯ সালে) কানাডা প্রবাসী একদল ভাষাপ্রেমিকদের সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পায়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারি আজ একদিনের ভাষা-প্রেমে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। আমরা একদিনের ভাষা-প্রেমে আবদ্ধ না থেকে চিরদিনের জন্য বাংলা ভাষাকে ভালোবাসতে শিখব এটাই প্রত্যাশা।
২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
লেখক: রাজনীতিবিদ, লেখক ও মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ।
তথ্যসূত্র :
১. আহমদ রফিক : ভাষা-আন্দোলন : ইতিহাস ও উত্তরপ্রভাব, পৃ. ৪৭, সময় প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৬
২. ড. মোহাম্মদ হাননান : একুশে ফেব্রুয়ারি জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক, পৃ. ১০২, কাকলী প্রকাশনী, ২০০০
৩. শেখ মুজিবুর রহমান : অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ১৯৬-১৯৭, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, ২০১২
৪. মোনায়েম সরকার ও অন্যান্য (সম্পাদিত) : ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু, পৃ. ২৮, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৯