
অনেক বছর আগের কথা। আমি তখন স্কুলে পড়ি, ঠিক বাসার পাশেই ছিলো আমার স্কুল।
ছোট বেলায় স্কুল নিয়ে জল্পনা কল্পনা থাকলেও স্কুল যাওয়ার পর সেটা হয়ে যায় একেবারেই উল্টো, ইচ্ছে না থাকলেও আব্বুর ভয়ে স্কুলে যাইতে হতো প্রতিদিন … প্রতিদিনের ন্যায় সেদিন ও খানিকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে স্কুলে গেলাম সেদিন স্কুলে একটা নতুন মেয়ে আসছে , মেয়েটার নাম ছিলো সুচি । পড়ালেখায় খুব একটা ভালো না হলেও খুব নম্র, ভদ্র ছিল। কিন্তু মাঝেমধ্যে অদ্ভুত আচরণ করত মেয়েটা.সুচি সবসময় খুব কম কথা বলতো তবে মাঝে মাঝে এমন এমন অনেক কথা বলত, যার সঙ্গে বাস্তব জগতের কোনো মিল নেই।
যা শুধু কল্পনাই করা যায়, সুচি এই অল্প সময়ে আমার অনেক টাই কাছের বন্ধু হয়ে গেছে ওর কথা গুলো আমার কাছে অদ্ভুত লাগলেও আমি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতাম তবে ওকে এসব নিয়ে কিছু বললে ও খুব রাগ করতো তাই আমি ওকে তেমন কিছুই বলতাম না ।
অনেক সময় ওর কথা শুনে খুব হাসি পেত।
এ জন্য ওকে নিয়ে মাঝে মাঝে আড়ালে হাসাহাসি করতাম আমরা। আমার অনেক বন্ধু তো প্রকাশ্যে ঠাট্টা-তামাশা করত। কিন্তু সুচি কখনো কারও সঙ্গে খারাপ আচরণ করতো না মাঝে মাঝে একটু রাগ করতো , রাগ করার পর বিষণ্ন হয়ে থাকত মেয়েটা।
মনে হতো ভাবনার সাগরে মিশে গেছে
সারাক্ষণ কী যেন ভাবত!
আর ক্লাসেও ছিল অনিয়মিত।
হঠাৎ করেই বছর শেষে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হলো,
সুচি অনিয়মিত ছিলো তাই আমাকে বার বার বলছিল ” নীলা এইবার আমি ফেল করলে আমি সত্যি সত্যি মরে যাব ” আমি ওকে সাহস জুগিয়ে বলেছিলাম দূর ভয় নেই আমি আছি তো আমি তোমাকে নোটস করে দিব ।
কথা বলতে বলতে ও হঠাৎ চুপচাপ হয়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে চলে গেলো কোথায় গেলো কেউ যানে না হঠাৎ আমাদের স্কুলের মাহিন স্যার এর চেঁচামেচিতে আমরা সবাই ক্লাসের বাইরে এসে দেখি জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে আছে সুচি ।
প্রায় আড়াই ঘণ্টা অজ্ঞান ছিল ও। জ্ঞান ফেরার পর স্যার ওকে জিজ্ঞাসা করলে, ও উওর দেয় ও নাকি অন্য কোনো জগতে ছিল। সেটা নাকি আমাদের দৃশ্যমান জগৎ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। অনেক বৈচিত্র্যময় ও অদ্ভুত সেই জগৎ। আমরা ওর কথা কিছুই বুঝতে পারিনি আমি ওকে অনেক বার বলেছিলাম ও আমার কথায় পাত্তা দেয় নি ।
আমরাও ভাবতাম ও হয়তো মজা করছে তাই কেউ ওকে আর এসব নিয়ে কিছু বলতাম না ।
পরীক্ষার চিন্তায় ওর সাথে কথা বলা প্রায় বন্ধ ছিল মাঝখানে দু একবার ফোন দিয়েছিলাম নোটস দেওয়ার জন্য কিন্তু ওর ফোন বন্ধ পেয়েছি তাই আর যোগাযোগ করতে পারি নি ।
তারপর বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলো, হঠাৎ একদিন একটা অচেনা ফোন নম্বর থেকে একটা ফোন আসে ফোনের ওপাশ থেকে আমাকে কাঁপা কাঁপা গলায় কে যেন বললো নীলা আমার সাথে যাবা আমার অদ্ভুত সেই জগৎে আমি জিজ্ঞেস করলাম “কে বলছেন” ওপাশ থেকে কোনো উওর আসলো না কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর , আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফোন টা কেটে যায় ।
পরে অনেক ভাবনার পর মনে হলো এটা তো সুচির গলা কিন্তু ও কেন আমাকে এসব বলবে কিছুই বুঝতে পারলাম না । কিছুদিন পর ফলাফল প্রকাশিত হলো নতুন ক্লাসে উঠলাম আমরা, তবে অদ্ভুত ব্যাপার আমাদের ক্লাসে প্রথম হয়েছে আর শুধু ক্লাসে না আট জেলার মধ্যে টপ হয়েছে সুচি , স্যার সহ সবাই আমরা খুব অবাক হলাম , মিডিয়া থেকে অনেকেই এলো ওর ইন্টারভিউ নিতে তবে সুচি কে পাওয়া গেলো না অনেক খোঁজাখুঁজির পরও ওর খোঁজ কেউ দিতে পারলো না ।
আমারা সবাই খুব খুশি নতুন ক্লাস আর পড়াশুনা নিয়ে ।
আমরা সবাই খুব ব্যস্ত হয়ে পরি সবাই নিয়মিত স্কুলে আসলাম , শুধু সুচি ছাড়া। আমরা এর কোনো কারণ খুঁজে বের করতে পারলাম না। তখন আমার ক্লাস টিচারকে সুচির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করলাম।
তিনিও কিছুই বলতে পারলো না ভেবেছিলাম ও হয়তো গ্রামে চলে গেছে তাই আমরাও আর ওর খোঁজ করলাম না ।
কিছু দিন পর এক সকালে আমি ঘুমাচ্ছিলাম হঠাৎ অন্তু আমার রুমে এসে আমাকে ডেকে কাঁপা কাঁপা গলায় বলছে ” আপু উঠো দেখো তোমার বন্ধু কে নিউজে দেখাচ্ছে আমি ঘুম ঘুম চোখে বললাম কাকে ?
ও বলল তোমার বন্ধু সুচি কে আমি তারাতারি টিভি রুমে গিয়ে দেখি নিউজে দেখাচ্ছে সুচি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। আমি নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না খানিকটা থমকে গেছিলাম হঠাৎ টিভিতে বলে উঠলো এই মৃত্যু কে অস্বাভাবিক মৃত্যু বলেছে পুলিশ তবে পুলিশ ওর ঘর থেকে কিছু চিরকুট খোঁজে পেয়েছে সেখানে লেখা ছিলো নীলা আমার সাথে যাবা আমার অদ্ভুত সেই জগৎে। আমি শুধু তোমাকেই নিয়ে যাব ।
আমি সেদিন অনেক কান্না করেছিলাম শুধু চেয়েছিলাম সুচি আবার যেন ফিরে আসে ওকে যে আমার সরি বলা বাকি আছে ।
সেদিন অনেক চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারিনি শুধু চোখের সামনে ভাসছিল সুচি আর নেই আর মনে কথা গুলো ঘুরছে সুচির মৃত্যুকে অস্বাভাবিক মৃত্যু বলেছে পুলিশ এতো টুকু মেয়ের কেই বা শত্রু হতে পারে এসব চিন্তা করতে করতে কখন যে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছিল মনে নেই হঠাৎ করেই দেখতে পেলাম সুচি আমার সামনে দাড়িয়ে আছে আর হাত দুটো বারিয়ে দিয়ে বলছে নীলা দেখো আমি এসেছি তোমার কাছে তোমাকে নিতে এসেছি আমার সাথে যাবা তুমি আমার এই অদ্ভুত জগৎে।
খানিকটা ভয় পেয়ে চোখ খুলে দেখি সামনে কেউ নেই এতক্ষণ আমি স্বপ্ন দেখছিলাম তবে সেদিন থেকে কানে শুধু একটা কথাই বাজে নীলা আমার সাথে যাবা আমার অদ্ভুত সেই জগতে ।
আজো ভুলতে পারি নি ওর এই কথা টা ।
● অর্পিতা ঐশ্বর্য কামাল কাছনা রংপুর ।