পীরগাছার বাসা ছাড়ার আগে যখন সব কিছু গোছানো শেষ হলো তখন আশেপাশের কিছু ছেলে এসে চেয়ার টেবিল ট্রাকে উঠাচ্ছিল
তখন মাহিম ভাইয়া একটা ডাইরি খুঁজে পেলো
এটা নীলার ছোট বেলায় ডাইরি কাজের ফাঁকে ভুলেই গিয়েছিল ডাইরি টার কথা
হঠাৎ মাহিম ভাইয়া নীলাকে উদ্দেশ্যে করে বলে ,
_____মিস নীলা!
____জ্বি ভাইয়া ?
____এটা আপনার ডায়েরী?
মাহিমের প্রশ্নের উত্তরে ঘাড় না ঘুরিয়েই নীলা মাথা নাড়লো। তার ঘর থেকে অন্য কারও ডায়েরী বের হবার কথা নয় এই মুহুর্তে।
_____হ্যাঁ ।
_____ বেশ মজারতো, বছর শেষ হবার আগেই দেখি পুরো ডায়েরী ভরে ফেলেছেন।
______উ? হু- লিখেছি…
______একদম বাস্তবের মতো করে।
______হু।
_______হাতের লেখাটা একদম বাচ্চা বাচ্চা।
______খুব ছোট বেলার ডাইরি ছিলো এটা
______পেজগুলো কেমন আটকে আটকে আছে। মনে হচ্ছে যেন অনেক পুরোনো।
______পুরোনোই, ডাইরি টা অনেক আগে কেনা।
আম্মু কিনে দিয়েছিল
মাহিম মনে হয় শুনতে পায়নি কথাটা,
______লেখায় কালিও কেমন ফ্যাকাশে হয়ে ছড়িয়ে ছড়িয়ে গেছে। ভিজে গিয়েছিলো নাকী?
এতোক্ষনে ঘাড় ঘোরালো নীলা। ভিজলো আবার কোনটা?
ডায়েরিটাকে এক দেখাতেই চিনতে পারলো সে।
প্রথম ডায়েরীটা। এর পর কত ডায়েরী পেয়েছে নিজের আম্মুর থেকে মনেও নেই, এ বছরের গুলোও হয়তো দেখে চিনতে পারবে না। কিন্তু এই ডায়রীটা ভোলার নয়। কোথায় যেন তুলে রেখেছিলো এটাকে?
______ এইটা কই পেলেন?
______ড্রয়ারের ভিতর, একদম নিচের দিকে।
_______অনেক দিন আগের ডায়েরী এটা। স্কুল লাইফের সম্ভবত।
_______বলেন কী?
_______আমার পাওয়া প্রথম ডায়েরী এটা, আম্মুর কাছ থেকে
_______ প্রথম ডায়েরী? ফাকা রেখে দিয়েছিলেন?
______না। একটা ফাকা রেখে কখনও নতুন খাতা ধরিনা আমি না।
______তাহলে এই পৃষ্ঠাগুলো ফাকা ছিলো?
হাত দিয়ে প্রথম দিকের কয়েকটা পৃষ্ঠা দেখালো মাহিম
______ না, ওগুলোও আগেই লেখা।
_______আহ, এসব আগের লেখা।
_______হ্যা। ঐ সময়েরই লেখা। একটা লাইনও ফাকা রাখিনি। খুব শখের ছিলো…
_______এই লেখা ঐ সময়ের?
_______হ্যা।
_______কাম অন…
______আরে বাবা, ঐ সময়েই আমি খুব চিন্তা ভাবনা করে লিখতাম।
_______ প্লিজ মিস নীলা, নো ফান।
কেন, খুব কী পাকামী টাইপের লেখা হয়ে গেছে? বয়সের তুলনায় একটু বেশীই বুঝতাম আমি।
_______তা জানি, কিন্তু তাই বলে ভবিষ্যতও বুঝতেন নাকি?
_______ তা বুঝতাম কিছুটা… আমার চিন্তা ভাবনা…
_______আরে আপনার জিনিয়াসের কথা হচ্ছেনা, আমি বলছি সম্ভাব্যতার কথা। নীলা ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো?
_______ ধ্যাৎ, বুঝিনা। এটা আমার অনেক আগে লেখা ব্যাস। আর আমি সম্ভবত বেবী জিনিয়াস ছিলাম।
________ যত জিনিয়াস হোননা কেন পাঁচ বছর আগে আপনি ঠিক এক মাস আগের বাস্তব হুবুহু কাহিনী লিখবেন কিভাবে আপনি?
কথাটা না বুঝে হা হয়ে থাকলো নীলা,
_______ এই যে দেখেন, এখানে সেদিন পিকনিকের বর্ণনা আছে, বন্ধুদের সাথে কথা কাটাকাটির ঘটনা ,
তমার হঠাৎ হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা আপনি বাচ্চা বয়সে লিখেছেন?
নীলা উঠে প্রায় ছিনিয়ে নিলো ডায়েরীটা।
নাহ, তেমন কোন ব্যাপার হলেও বছর খানিক আগে হয়েছে। ধুলো ময়লাগুলো অন্তত তাই বলে।
লেখা পড়েই স্থির হয়ে গেলো নীলা। এগুলো তারই লেখা,
হায়রে আল্লাহ…
______কী আপনার লেখা না?
______ হ্যা। আমারই তো।
মাহিম কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলো না তবে এ নিয়ে আর কথা না বাড়িয়ে ডাইরি টা নীলার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল, সেদিন থেকে ডাইরিটা আর পড়া হয়নি কাজের চাপে আজ এতোদিন পর আবার সেই ডাইরি কি কি
যে লিখেছিলো বিন্দু মাত্র মনে নেই নীলার
ব্যালকনিতে বসে নীলা একটু চিন্তা ভাবনা করে ডাইরিটার প্রথম পাতাটা খুলতেই দেখতে পেলো ছোট ছোট করে নিজের পরিচয় লিখে রেখেছিলো বাহ্ বেশ মজার তো
যাই হোক ছোট বেলায় নিজেকে একটু বেশি জিনিয়াস ভাবতাম হঠাৎ মনে মনে ভাবতে থাকে নীলা
এতো বছর পর নিজের ছোট বেলার পরিচয় দেখে নীলার বড্ড বেশি হাসি পেলো ,
পরের পাতায় লেখা ছিলো তারিখ ২৩ নভেম্বর সেদিন নীলার জন্মদিন ছিলো এটা সম্ভবত সে তার আম্মুকে উদ্দেশ্যে করে লিখেছিলো অনেকটা অভিমান নিয়ে তারপরের পাতায় বড় বড় করে লিখা ছিলো
‘ ভালোবাসি আম্মু ‘
তারপর তাদের আচমকা পীরগাছা থেকে চলে আসা স্কুলে না যাওয়ার জন্য আব্বুর হাতে মাইর খাওয়া,
সবটাই লেখা ছিলো সেই ডাইরি তে
সবটাই কতটা অদ্ভুত ছিলো তখন
লেখা গুলো একটু বেশি আঁকাবাঁকা সে মুচকি হেসে এক এক করে পাতা উল্টাতে থাকে
হঠাৎ একটা পাতায় গিয়ে তার চোখ দুটো আটকে যায় ডাইরির উপরে তারিখ ছিলো ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১১
জীবনের প্রথম প্রেমের গল্প
তারপর অনেক সুন্দর করে কিছু কথা লেখা ছিলো লিখা গুলো যেন এতো বছর পর বড্ড বেশি অচেনা হয়ে গেছে
লেখা গুলোর দিকে নীলা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে প্রথম ভালোবাসা যেন অন্যরকম অনুভূতি
তবে সেই অনুভূতি আজ একটু বেশি ফ্যাকাসে হয়ে গেছে
এখন সবটা জুড়ে শুধুই রিক্ত ।
রিক্ত কে ছাড়া নীলা অন্য কাউকে যেন কখনো কল্পনা করতে পারে না ।
সেদিন হঠাৎ করেই চারদিক মেঘে ঢেকে রেখেছে।
বাইরে তাকালে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শৌ শোঁ করে শব্দ আসছে বাতাসের।
নীলা রুমে শুয়ে বই পড়ছিল , বই পড়াতে এতোটা ব্যস্ত ছিলো যে বাইরে বৃষ্টি এসেছে সেদিকে তার কোন ভাবনা নেই,
হঠাৎ রুমে নীলার আম্মু এসে কয়েকবার নীলা নীলা বলে ডাকতেই নীলা বইটা থেকে মুখ তুলে সে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো
______ আম্মু কিছু বলবে ?
______ আকাশ মেঘলা , বৃষ্টি আসবে ব্যালকনি থেকে কাপড় গুলো রুমে নিয়ে আসো ,
নীলা তার আম্মু কে কিছু না বলে চুপচাপ বিছানা থেকে ওঠেই ব্যালকনিতে চলে যায় সত্যিই তো অনেক জোড়ে বৃষ্টি এসেছে তার ওপর বজ্রপাতের তুমুল শব্দ যেন কান ফেটে যাচ্ছে।
নীলা তারাতারি কাপড় গুলো তুলে রুমে নিয়ে আসলো ,
এতো জোরে বজ্রপাত হচ্ছে যে নীলার ভয় করছে বারান্দায় যেতে। দরজা খুললে ধাক্কা দিয়ে আবার বন্ধ করে দিচ্ছে বাতাস। বজ্রপাতের প্রচণ্ড শব্দ উপেক্ষা করেই নীলা আবার বারান্দায় গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে
রইল।
নীলার বুকের ভেতর কেমন যেন শব্দ করছে। মনে হচ্ছে আজ বুকের মাঝেও প্রচণ্ড ঝড় উঠেছে। দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে ভেতরের সকল অবয়ব।
হিমালয়ের গুহার মধ্যে জমে থাকা সকল বরফ গলতে শুরু করছে। বুকের ভেতর যে দ্রুতগতিতে হার্টবিট হচ্ছিল তা এখনো টের পাচ্ছে নীলা, রিক্তের কথা খুব মনে পড়ছে আজ
রিক্তের কথা মনে পড়তেই নীলার বুকের মাঝে যেন কাঁপুনি আরও বেড়ে গেল। কোনোভাবেই সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। পুরো শরীরই কাঁপছে এখন। বারান্দার গ্রিল ধরে রাখতে পারছে না। তার ওপর প্রচণ্ড
বাতাসও তাকে ফেলে দিতে চাচ্ছে।
নীলার চোখে বিন্দু অশ্রু জমেছে কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো নীলার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়বে বৃষ্টি।
নীলা নিজের মনকে শক্ত করে গ্রিল ধরেই বসে পড়ল। এরপর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে। কখন যে নীলার পুরো চোখ ভেসে সাগর হয়ে গিয়েছে সে নিজেও টের পায়নি।
হঠাৎ করে মুখে হাত দিতেই নীলা দেখল চোখের জলে তার মুখ ভিজে গড়িয়ে পড়ছে।
চারদিকে তখনো কালো মেঘে ঢাকা , কালো মেঘে পুরো শহর অন্ধকারে ঢেকে গেছে
নীলার মন ভালো নেই ঠিক আছে কিন্তু আকাশেরও তো মন ভালো নেই। না, এ হতে পারে না। কোনোভাবেই
কাঁদা যাবে না। বুকের মাঝে যত ঝড়ই উঠুক না কেন তা দমিয়ে রাখতে হবে। চেহারায় যতই মেঘ ভার করুক-না কেন তা বৃষ্টি হয়ে চোখ ভেজানো যাবে না।
যে নিজের ইচ্ছেই হারিয়ে গেছে তাকে ভেবে কি লাভ
যতই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে ততই নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যাচ্ছে সে। চোখ দিয়ে বৃষ্টি আরও জোরে নামছে তার। যতবারই সে রিক্ত কে ভুলতে চায় তার চেয়ে বেশি বেশি ভাসছে চোখে ।
নীলার মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছে। এখন সে কী করবে নিজেও বুঝতে পারছে না। শুধু বারবার আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ মুছছে ওড়না দিয়ে।
এর মধ্যেই হঠাৎ নীলার আম্মু রুমের জানালা দিয়ে নীলাকে ডাকতে থাকে
সে তার আম্মুর ডাক শুনতে পেল,
— এই নীলা এমন প্রচন্ড বৃষ্টি আর বজ্রপাত হচ্ছে বাইরে কি করো তুমি রুমে এসো তার আম্মুর এমন রাগী কন্ঠস্বর শুনে সে যেন হকচকিয়ে উঠল কিছু না বলে চুপ করে তাড়াতাড়ি ওড়না দিয়ে চোখ-মুখ মুছতে লাগল।
নীলার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে ওর আম্মু এবার জোরে ডাক দিলো,
_____এই নীলা তোমাকে ডাকছি না, তারাতারি রুমে এসো
_____আসছি আম্মু ।
_____ তারাতারি ,
_____ হুম
নীলার কথা শুনে মিসেস আদনান নিচে ডাইনিংরুমে চলে গেলেন ,
আসছি বলে নীলা তাড়াতাড়ি রুমে এসে ওয়াশরুমে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে ডাইনিং রুমে আসলো।
হঠাৎ করে নীলার আম্মু মিসেস আদনানের চোখ পড়ল নীলার চোখের ওপর।
সাথে সাথেই জিজ্ঞেস করলেন,
____কি হয়েছে তোমার চোখ লাল কেন?
____কই, না তো আম্মু।
____ আবার মিথ্যে কথা খেয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দেখো।
____বাইরে প্রচন্ড বাতাস ছিলো না তাই হয়তো চোখে কী যেন একটা পোকা পড়েছিল। তারপর চোখে অনেক
চুলকিয়েছি হাত দিয়ে, হয়তো তার জন্য হতে পারে ।
______ আমাকে ডাকলে না কেন, আর চোখে কিছু পড়লে এভাবে হাত দিয়ে চুলকাতে হয় না। পানি দিয়ে
ভালো করে ধুলেই হতো আর ওড়নার কিছু অংশ মুখে নিয়ে তা দিয়ে চোখে ভাপ দিলে ভালো হয়।
_______পরে ধুয়েছি ভালো করে তার পরো কমছে না ।
কথাগুলো বলছিল আর বুকের মাঝে শিরশির করছিল নীলার । নীলা যে বানিয়ে বানিয়ে কথা বলছে তা বুঝতে বাকি ছিল না তার আম্মুর ।
তিনি সব কিছু বুঝেও না বুঝার ভান করে ছিলেন
মন চাচ্ছিল কিছু বলতে কিন্তু সবার সামনে নীলাকে বিচলিত করতে চাননি তাই নিজেকে সামলে নিল। শুধু বলল,
_____খেয়ে নেও তারাতারি ।
_____ঠিক আছে আম্মু ।
_____ শুনো খেয়ে আগে আমার রুমে এসো দেখি কোনো সমস্যা হলো কি না।
_____না আম্মু কোনো সমস্যা হবে না, এ নিয়ে তুমি কোনো চিন্তা করো না।
_____ঠিক আছে, তবে বারোটার পরে যেন আর জেগে থাকতে না দেখি।
নামাজ আদায় করেছো ?
_____ নাহ্ আম্মু
_____ আচ্ছা খেয়ে নামাজ আদায় করে পড়তে বসিও ।
নীলা কোনো কথা বলল না, মাথা নিচু করে রইল।
______ চুপচাপ হয়ে আছো যে, কিছু বলছো না
______ ঠিক আছে আম্মু
চুপচাপ খেয়ে নীলা তার রুমে চলে গেল। রাত দশটা বাজে।
নীলা ফ্রেস হয়ে অজু করে নামাজ পরতে বসলো , নামাজ পড়ে সে পড়ার টেবিলে পড়তে বসলো ।
কিন্তু পড়তে ভালো লাগছে না। তারপরেও জোর করে পড়ছে।
হঠাৎ নীলার চোখ দুটো ফোনের দিকে আটকে গেলো সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ফোনের দিকে ,
কিসের যেন অপেক্ষা
এ অপেক্ষার যেন কোন অবসান নেই,
কেউ আর নিয়ম করে ফোন করে না , ফোনের ওপাশ থেকে কেউ হ্যালো বলে না
সবটাই যেন এখন শুধু কল্পনা ।
● অর্পিতা ঐশ্বর্য, কামাল কাছনা রংপুর