প্রখ্যাত অভিনেত্রী শ্রদ্ধেয়া করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় এর শুভ জন্মদিন স্মরণে

প্রখ্যাত অভিনেত্রী শ্রদ্ধেয়া করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় এর শুভ জন্মদিন স্মরণে

বাংলা চলচ্চিত্রের ‘ সর্বজয়া ‘ করুণা ( পিতৃদত্ত নাম : করুণাকণা সেন ) বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবারের আদি নিবাস ছিল অধুনা বাংলাদেশের খুলনার পয়োগ্রামে। যদিও করুণার জন্ম হয় ১৯১৯ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর সাঁওতাল পরগণার মহেশপুরে। তাঁর পিতা শচীন্দ্রনাথ সেন ছিলেন পেশায় চিকিৎসক। মাতা সুধাদেবী একজন গৃহবধূ হলেও পড়াশোনার মধ্যেই থাকতে ভালবাসতেন। করুণারা তিন ভাইবোন মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন বইপড়ার প্রতি একান্ত আগ্রহ। বড় দুই দাদা রবীন্দ্রনাথ আর আর্যকুমার ছোটবোন করুণাকণাকে সবসময়ই সঙ্গ দিতেন এবং লেখাপড়া শেখাতেন। জানলে অবাক হতে হয় পরবর্তী কালে ইংরেজি সাহিত্যের একজন অত্যন্ত সফল ছাত্রী করুণা ছেলেবেলায় কখনও স্কুলেই যাননি। পিতামাতা এবং দুই কৃতী দাদাই ছিলেন করুণাকণার শিক্ষক। পরবর্তী কালে প্রাইভেটে ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাশ করে কলকাতার যোগমায়া দেবী কলেজে ভর্তি হন করুণা। কিন্তু ক্রমশ তিনি বুঝতে থাকেন তাঁর পরিবারের আর্থিক কষ্টের কথা। কিন্তু অনেক চিন্তা করেও সেই তিরিশের দশকের গোড়ায় উত্তাল রাজনৈতিক পরিস্থিতির সামাজিক প্রেক্ষাপটে কিছুতেই বুঝতে পারেননি ঠিক কীভাবে তিনি তাঁর পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেবেন।

১৯৪১ সালে করুণা এম এ পাশ করেন। আর ১৯৪৩ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সহপাঠী সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। যদিও জানা যায় এই বিবাহ নিয়ে প্রথমে উভয়ের পরিবারের যথেষ্ট আপত্তি ছিল। প্রথম কারণ অবশ্যই বৈদ্য ( সেন ) এবং ব্রাহ্মণ ( বন্দ্যোপাধ্যায় ) দুই পাত্রপাত্রীর অসবর্ণ বিয়ে এবং দ্বিতীয় কারণ ছিল করুণার পরিবার গোঁড়া কংগ্রেসী অপরদিকে সুব্রতবাবুরা ছিলেন মার্কসবাদী। কিন্তু উভয়ের মায়েদের মধ্যে এইসময় হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল ফলে বিবাহের সব বাধা দূর হয়ে যায়। সুব্রতবাবুর সঙ্গে করুণার অন্তরঙ্গতা আগে থেকে থাকলেও সামাজিক বিবাহের পূর্বেই সুব্রতবাবুর পিতার কাছে ছাত্রী হিসেবে ইংরেজি সাহিত্য পড়তে আসতেন করুণা। এখানে বলা প্রয়োজন, সুব্রতবাবু এবং করুণা উভয়েই ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের পড়ুয়া। যে অসামান্য অভিনেত্রীর কথা আজ আমরা আলোচনা করতে শুরু করেছি এই সময় চলচ্চিত্রের অভিনয়ে আসার চিন্তাও ছিল তাঁর কাছে সম্পূর্ণ অবান্তর এক বিষয়।

১৯৪১ সালে এম এ পাশ করে করুণার স্বামী ( তখনও বন্ধু ) সুব্রতবাবু কিছুদিন চলে গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে শিক্ষকতা করতে। কিন্তু আদ্যন্ত কমিউনিস্ট চিন্তাধারার ব্যক্তি সুব্রত এইসময় পড়েন তৎকালীন ইংরেজ শাসকদের কুনজরে। কবিগুরুর শান্তিনিকেতনের উপর এমনিতেই তাদের সজাগ দৃষ্টি থাকতই, উপরন্তু ইংরেজ শাসকদের বিষদৃষ্টিতে ছিলেন কমিউনিস্টরা। এর ফলে সুব্রতবাবুকে শান্তিনিকেতনের চাকরি ছেড়ে চলে আসতে হয় এবং পার্টির নির্দেশে সুব্রতবাবুকে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে হয়। সুব্রত – করুণার বিবাহের পরপরই স্বামীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন করুণা। সুব্রতবাবুকে যুদ্ধে অংশ নিতে চলে যেতে হয় ইন্দোচিনে। এদিকে কলকাতায় কুখ্যাত বাংলার মন্বন্তরের দিনগুলো করুণাকে একাই যাপন করতে হয়।

অত্যন্ত কড়াধাতের মানুষ করুণা ছোট ছোট দেওরদের রীতিমতো অভিভাবিকার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তাঁর দেওর সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন এইসময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে কলকাতায় ঘাঁটি গেড়েছে ব্রিটিশ আর মার্কিন সেনারা এবং এরা সুযোগ পেলেই শুরু করে বেলেল্লাপনা। পাবলিক বাসে দেওরদের স্কুলে নিয়ে যাওয়ার সময় তরুণী করুণা ব্যাগে রাখতেন চাবুক। বাসে যদি কখনও কোনো শ্বেতাঙ্গ সেনা উঠত করুণা নিজের ব্যাগ থেকে সেই চাবুক বের করে হাতে নিয়ে বসে থাকতেন!

এই অসামান্য দৃঢ়তা ছিল তাঁর চরিত্রের অনন্যতা। তাই স্বামীর কৃতী বন্ধু মানিক ( সত্যজিৎ রায় ) যখন তাঁর ‘ পথের পাঁচালী ‘ র সর্বজয়া চরিত্রের জন্য করুণাকে নির্বাচিত করেন তখন করুণা সটান সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। যদিও ‘স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির চাপে ‘ তাঁকে সেই প্রস্তাবে মত দিতেও হয়, এবং যার ফলে বিশ্বচলচ্চিত্রের ইতিহাসে একজন অসাধারণ শক্তিশালী অভিনেত্রীর নাম চিরতরে সংযোজিত হয়। ইতিপূর্বে অবশ্য করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বামী সুব্রতবাবুর সৌজন্যে জড়িয়ে পড়েছিলেন ভারতীয় গণণাট্য সংঘের সঙ্গে। স্বামীর রাজনৈতিক চেতনা তাঁকেও করেছিল প্রভাবিত। করুণার শাশুড়ি নলিনী বন্দ্যোপাধ্যায়ও গণনাট্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

১৯৪৮ সালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা হতে প্রথমে গা ঢাকা দিলেও পরে সুব্রতবাবু গ্রেপ্তার হয়ে নাসিক জেলে বন্দি হন অন্যদিকে সদ্যোজাত কন্যাকে নিয়ে আবারও করুণা একা হয়ে পড়েন। সংসার সামলে চাকরির চেষ্টায় তিনি শর্টহ্যান্ড ও টাইপ শেখেন এবং এমন সময়ে ‘ নবান্ন ‘ নাটকটি দেখে তাঁর মনোজগতে এক তুমুল পরিবর্তন তৈরি হয়। তিনি প্রবলভাবে গণণাট্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। সংসার, অভিনয়, গণণাট্য আন্দোলনের ঝুঁকি সবকিছু সামলে করে গেছেন নিয়মিত সাহিত্য রচনাও। ১৯৪২ সালে অরণি পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর ছোটগল্প ‘ লক্ষ্যভেদ ‘। গণণাট্য সংঘের হয়ে করুণা অভিনয় করেছিলেন সলিল চৌধুরীর লেখা দুটি নাটক – ‘ জনান্তিকে ‘, ‘ সংকেত ‘ – এ; এছাড়া ‘দক্ষিণী ‘ র জন্য কবিগুরুর ‘ নষ্টনীড় ‘ এর চারুলতা চরিত্রে ; রাজেন তরফদারের পরিচালনায় ডি জে কিমারের অফিস ক্লাবে ‘ চিরকুমার সভা ‘ নাটকে ‘শৈলবালা’ চরিত্রে ; উৎপল দত্তের পরিচালনায় ইবসেনের ‘ গোস্টস ‘ নাটকে রোজিনা এবং ‘ ডলস হাউস ‘ নাটকে নোরার ভূমিকায় অভিনয় করে প্রভূত প্রশংসা অর্জন করেন করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় ।

বাংলা তথা ভারতীয় তথা বিশ্বচলচ্চিত্রের জগত করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মনের মণিকোঠায় রাখবে তাঁর অভিনীত ‘ সর্বজয়া ‘ চরিত্রের জন্য। কিংবদন্তি সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অমরসৃষ্টি সর্বজয়ার মতোই তো সর্বংসহা ছিলেন করুণা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেও। বোধহয় সেই কারণেই সম্পূর্ণ সুবিচার করতেও তিনি পেরেছিলেন সর্বজয়া চরিত্রটির প্রতি। এই বিষয়ে নির্বাচক সত্যজিৎ রায়ের কৃতিত্ব অনস্বীকার্য। সত্যজিৎ রায়ের দুটি অনন্যসাধারণ কীর্তি ‘ পথের পাঁচালী ‘ এবং ‘ অপরাজিত ‘ তে সর্বজয়া চরিত্রটি ছাড়াও বিশ্ববরেণ্য এই চলচ্চিত্রকারের সঙ্গে করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় কাজ করেছেন ‘ দেবী ‘ এবং ‘ কাঞ্চনজঙ্ঘা ‘ ছবিতে। মাত্র দিন চারেক কাজ করেন ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত অসমাপ্ত ছবি ‘ কত অজানারে ‘ তে। জীবনের শেষদিকে এসে কাজ করেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘ অন্ত্যেষ্টি ‘ ছবিতে। ১৯৫৯ সালে ব্রিটিশ অ্যাকাডেমি অব ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন আর্ট তাদের দ্বাদশ ব্রিটিশ ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড ( সংক্ষেপে ‘বাফতা’ ) দেওয়ার জন্য যে ছ’ জন অভিনেত্রীর তালিকা তৈরি করে তার মধ্যে অন্যতম নাম ছিল করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

তাঁর অসাধারণ দৃঢ় মনোবলের সমকক্ষ কোনও চরিত্র বাংলা চলচ্চিত্র জগত তৈরি করতে পারেনি তাই করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো শক্তিশালী অভিনেত্রীর ডাকও পড়েনি। কিছু ক্ষেত্রে তিনি নিজেও প্রত্যাখ্যান করেছেন অভিনয়ের ডাক। কেননা চলচ্চিত্রকে কোনদিনই তিনি ‘ কেরিয়ার ‘ মনে করেননি। সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় চারটি ছায়াছবিই তাঁর অভিনয়জীবনকে তৃপ্ত করার জন্য যথেষ্ট ছিল বলেই মনে করেছেন করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর জীবনের শেষপর্যন্ত। ২০০১ সালের ১২ই নভেম্বর লোকান্তরিত হন এই অসামান্য অভিনেত্রী।

তথ্য ঋণ : আনন্দবাজার পত্রিকা

সময়ের কথায় প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

Facebook fan page

Leave a Reply

Your email address will not be published.